‘আমার জীবনের সবকিছু সুন্দরবনেরই দান’

নৌকার ওপর বসে জাল মেরামত করছেন খুলনার কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকার বনজীবী জেলে আবদুল্লাহ সরদার ও তাঁর স্ত্রী। সোমবার সকালে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা নদীর চরেছবি: প্রথম আলো

‘আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে, অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাই রে’ ভাঙা গলায় গাইছেন কে যেন! খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা মহেশ্বরীপুর এলাকার বেড়িবাঁধ ধরে চলার সময় দূর থেকে ভেসে আসে এই গানের আওয়াজ। সুর নেই, তাল নেই; কিন্তু মাদকতা আছে সেই গলায়। কিছুটা সামনে এগোতেই দেখা গেল, কয়রা নদীর চরে নৌকায় বসে ছেঁড়া জাল মেরামত করতে করতে গান গাইছেন একজন। পাশে একজন নারী জাল মেরামতের কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছেন। নৌকার মাথায় একটি শিশু বইখাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

কাছাকাছি পৌঁছাতেই গান বন্ধ করলেন ওই ব্যক্তি। কোনো কথা না বলে একইভাবে কাজ করতে থাকলেন। শুধু নৌকার মাথায় বসে বড় বড় চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ছোট মেয়েটি। ‘ও ভাই, মাছ ধরতে জঙ্গলে যাবেন কবে?’ জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর নেই। উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কে? প্রশাসনের লোক নাকি?’ ‘না’ শুনতেই একগাল হেসে জবাব দিলেন, ‘দু-এক দিনের মধ্যে নামব। সেই ছোটকাল থেকে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরতিছি। এখনো সেই মাছ ধরেই যাচ্ছি। এই যে জাল–নৌকা দেকতিছেন, জঙ্গলের টাকায় অল্প অল্প করে সবকিছু বানাইছি। আমার জীবনের সবকিছু সুন্দরবনেরই দান।’

এই ব্যক্তির নাম আবদুল্লাহ সরদার। বয়স ৪০-এর মতো, কমবেশি হতে পারে। তাঁর বাড়ি মহেশ্বরীপুর গ্রামের কয়রা নদীর বেড়িবাঁধের পাশে। আজ সোমবার সকালে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘২০ বছর ধরে জঙ্গল করি (বনের নদী ও খালে মাছ ধরেন)। মাছ ধরার গোন আসলেই সুন্দরবনে যেতে হবে। চাঁদের হিসাবে দশমীর রাত বা একাদশী থেকে মাছ ধরার গোন শুরু। চলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার পর পর্যন্ত। আমার নৌকায় স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুল আর আনারুলও যায়। তিনজন মিলে টানা ছয় দিন বনের নদী খালে মাছ ধরি।’

কথায় কথায় আবদুল্লাহ সরদার বলেন, বাড়ি থেকে বনের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে চাল, ডাল, তরিতরকারি, খাবার পানি—সব নৌকায় করে নিয়ে যান। ছয়-সাত দিন চলে নৌকার মধ্যেই রান্না, খাওয়াদাওয়া, ঘুম। জালে চিংড়ি, ভেটকি, দাতিনাসহ সব মাছই ওঠে। মাছ বিক্রি করে খরচ বাদে টাকা ভাগ করে নেন তিনজন। একেকজনের ভাগে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা হয়।

জঙ্গলের মধ্যে ভরপুর মাছ খাওয়া হয় জানিয়ে বনজীবী জেলে আবদুল্লাহ বলেন, নৌকায় মাথায় বসানো হয় বিশেষ কায়দায় বানানো টিনের চুলা। নৌকার গলুইয়ে চলে মাছ কাটাকুটির কাজ। এরপর লবণ ও মসলা মাখিয়ে মাছ ওঠে চুলায়। জালে মাছ উঠলে আগে যেটা খেতে মনে চায়, সেটাই খান, তারপর বেচাবিক্রি। তাঁদের জালে ১৫ থেকে ১৭ কেজি ওজনের ভেটকি মাছও পেয়েছেন।

নৌকায় বসে জাল মেরামতের কাজে সহযোগিতা করছিলেন আবদুল্লাহ সরদারের স্ত্রী হুমায়রা খাতুন। এবার তিনি বললেন, এই এলাকার প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনে যায়। মধুর মৌসুমে কিছু মানুষ মধু কাটতেও যায়। বাড়ির লোকজন যখন জঙ্গলে যাওয়ার উদ্দেশে ঘর ছাড়ে, তখন মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। কত মানুষ বাঘ, কুমিরের কামড়ে মারা গেছে! বনের মধ্যে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও থাকে না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে মানুষগুলোর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন পরিবারের লোকজন।

নৌকার মাথায় চুপচাপ বসে গল্প শুনছিল আবদুল্লাহ-হুমায়রার একমাত্র শিশুকন্যা। নাম জান্নাতুন নেছা। পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। জঙ্গল থেকে বাড়িতে ফিরলে মেয়েটা আর বাবাকে ছাড়তে চায় না। প্রত্যয়ী কণ্ঠে আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমি লেখাপড়া শিখিনি। আফসোস তো আছেই। মেয়েটারে ভালো করে লেখাপড়া শেখাব।’