সন্তানের খাবার কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন শাহরিয়ার, চুয়াডাঙ্গায় মাতম

নিহত শাহরিয়ার শুভর পরিবারের সদস্যরা। বুধবার চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ। ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মারা যান তিনি।

মঙ্গলবার রাতেই চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয় শাহরিয়ারের মরদেহ। আজ বুধবার সকালে তাঁকে দাফন করা হয়। হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদে বন্দুকের গুলিতে আহত, গুলির আঘাতে মাথার খুলি চুরমার ও মস্তিষ্কে ক্ষতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল সকাল ১০টায় শংকরচন্দ্র গ্রামে শাহরিয়ারদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকার্ত মানুষের ভিড়। উঠানে তাঁবুর নিচে বাবা আবু সাঈদ মন্ডলকে ঘিরে আছে প্রতিবেশীরা। ঘরের ভেতর থেকে সন্তানহারা মা চম্পা খাতুন ও সদ্য বিধবা রাজিয়া সুলতানার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। কোনো কিছু না বুঝেও পিতৃহারা শিশু মুহিন ছোট চাচা সিয়ামের কোলে অনবরত কেঁদে চলেছে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দেবেন, সে ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন।

শাহরিয়ারের কথা বলে অনবরত কেঁদে যাচ্ছিলেন মা চম্পা খাতুন। তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। সংসারে যখন সুখের দেখা মিলল, তখনই শাহরিয়ারের মৃত্যু সবকিছু এলোমেলো করে দিল।

শাহরিয়ার শুভ শংকরচন্দ্র গ্রামের কৃষক আবু সাঈদ মন্ডল-চম্পা খাতুন দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে মেজ। তিনি যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা শেষে ঢাকায় লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা ও সাত মাস বয়সী ছেলেসন্তান মোহাম্মদ মুহিনকে নিয়ে ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। শাহরিয়ারের বড় ভাই সাদ্দাম হোসেন ঢাকার একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। ছোট ভাই সিয়াম আলী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একমাত্র বোন লিজা খাতুন গৃহিণী। ঘটনার দিন সিয়াম আলী মেজ ভাই শাহরিয়ারের বাসায় অবস্থান করছিলেন।

প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ
ছবি: সংগৃহীত

সিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় ১৮ জুলাই ভাই শাহরিয়ারের বাসায় গিয়ে ওঠেন। পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে শিশু মুহিনকে নিয়ে দুই ভাই ঘুমান। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে শাহরিয়ার ছোট ভাই ও ছেলের জন্য খাবার কিনতে বাইরে বের হন। বাসা থেকে বের হয়ে কিডনি ফাউন্ডেশনের সামনে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় বসে আত্মরক্ষা করার সময় একটি গুলি এসে শাহরিয়ারের মাথায় আঘাত করে।

সিয়াম বলেন, বাসা থেকে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর ভাবি ভাইয়ের নম্বরে কল করলে কয়েকবার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তিনিও কল করে ফোন বন্ধ পান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে গ্রাম থেকে চাচাতো ভাই ইমন আলী শংকরচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মহিউল ইসলামের কাছে জানতে পারেন, শাহরিয়ার ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শাহরিয়ারের কাছে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৯৯৯ নম্বরে বিষয়টি জানায়। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা–পুলিশের মাধ্যমে পরিবারকে জানানো হয়।

সিয়াম জানান, তিনি শাহরিয়ারের সন্ধানে বাসা থেকে বের হয়ে একদল অস্ত্রধারীর মুখোমুখি হন। ভাইয়ের মুমূর্ষু অবস্থার কথা বলে সেখান থেকে ছাড়া পান। তবে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়ে ভাইয়ের হদিস পাচ্ছিলেন না। পরে পুলিশের সহযোগিতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে যান। এ সময় হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে শাহরিয়ারের মাথা থেকে গুলি বের করতে অস্ত্রোপচার চলছিল। শনিবার দুপুরে আইসিইউয়ে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মারা যান।