মধু সংগ্রহে মৌয়ালদের সুন্দরবনযাত্রা
কয়েক দিন আগেই নৌকা সংস্কার ও বাজারসদাই করে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন হাবিবুর রহমান শেখ (৪০)। আজ সোমবার সকালে তিনি বন বিভাগ থেকে পাস (অনুমতিপত্র) হাতে পান। কিছুক্ষণ পরই আটজন সহযোগী নিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে রওনা হন তিনি।
হাবিবুর শেখের বাড়ি খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামে। আজ সকালের দিকে তাঁর সঙ্গে কথা হয় শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে। নৌকা ছাড়ার আগে তিনি বলেন, টানা ১৪ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে মধু ও মোম সংগ্রহ করে ফিরে আসবেন। পরে আবার সুন্দরবনে যাবেন। এভাবে টানা দুই মাস—৩১ মে পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করবেন।
হাবিবুর শেখের মতো কয়রার গোলখালী, আংটিহারা, জোড়শিং, উত্তর বেদকাশী, পাথরখালী, পল্লীমঙ্গল, মঠবাড়ি, বানিয়াখালীসহ সুন্দরবন-সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মৌয়াল আজ সকাল থেকে সুন্দরবনে ঢুকতে শুরু করেছেন। সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, কয়রার সুন্দরবন-সংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীরে বেঁধে রাখা মৌয়ালদের নৌকায় কেউ খাবার পানি ভর্তি ড্রাম ও মধু রাখার পাত্রগুলো সাজিয়ে রাখছেন। নৌকার সামনের অংশে মাটির চুলা আর প্রয়োজনীয় বাজারসদাই রেখে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন সুন্দরবন যাত্রার। কেউ কেউ অনুমতিপত্র না পেয়ে বন বিভাগের কার্যালয়ের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছেন। আবার কেউ অনুমতিপত্র নিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন।
পল্লীমঙ্গল গ্রামের আল-আমীন গাইন বলেন, প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করে ১৪ দিনের জন্য সাত সদস্যের দল নিয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছেন। তবে এবার বন থেকে মাছ ও কাঁকড়া শিকারের আড়ালে চুরি করে আগাম চাক থেকে মধু কেটেছে মধু চোর চক্র। তাই মধু কেমন হবে, তা বলা যাচ্ছে না। বেশি মধু না পেলে চালান মার যাবে। তখন ঋণের বোঝা টেনে বেড়াতে হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আজ থেকে শুরু হওয়া এই মধু আহরণ মৌসুম চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত। এ বছর সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার কুইন্টাল। আর মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০০ কুইন্টাল। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগে ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কুইন্টাল মধুর জন্য মৌয়ালদের ১ হাজার ৬০০ টাকা ও মোমের জন্য ২ হাজার ২০০ টাকা রাজস্ব দিতে হবে।
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের সামনের নদীতে বেঁধে রাখা নৌকায় ছাউনি সংস্কার করছিলেন মৌয়াল শাহাদাত গাজী। তিনি বলেন, খাবার পানি, লবণ, মরিচ থেকে শুরু করে এক সংসারের খুঁটিনাটি সব জিনিসপত্র নিয়ে মধুর চাক কাটতে যাচ্ছেন। সুন্দরবনের গহিন থেকে মধু সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়।
মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ও গরান ফুলের মধু আসে। এরপর আসে কেওড়া। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশার মধু। জুন মাসে আসে গেওয়া ফুলের মধু। তবে জুন মাস থেকে সুন্দরবনের সব ধরনের জলজ ও বনজ সম্পদ আহরণে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় গেওয়ার মধু সংগ্রহ সম্ভব হয় না।
কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম গাজী বলেন, তাঁরা একটি নৌকায় আটজন মৌয়াল বনে যাচ্ছেন। গত বছর তাঁদের দলের প্রত্যেক সদস্য দুই মণ করে মধু পেয়েছিলেন। পাস সংগ্রহ, সরকারি রাজস্ব এবং খাওয়া খরচ মিলিয়ে মৌসুমে একেকজনের খরচ হয় ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর দুই মণ মধু বিক্রি করে একেকজন ৬০ হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন। এ বছরও আশানুরূপ মধু পাবেন বলে মনে করছেন তাঁরা।
সুন্দরবনে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগ থেকে মৌয়ালদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। তিনি বলেন, উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা হলো সংরক্ষিত অভয়ারণ্য থেকে মধু আহরণ করা যাবে না, কোনো মৌয়াল নিষিদ্ধ বনাঞ্চলে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক তাঁর অনুমতি বাতিল করা হবে। মৌয়ালেরা মৌমাছি তাড়াতে মশাল বা অনুরূপ কোনো দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না। কোনো অবস্থাতেই মৌচাকের সম্পূর্ণ অংশ সংগ্রহ করা যাবে না।
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, মৌয়ালদের প্রতিটি নৌকায় ১০-১২ জন বাওয়ালি অবস্থান করতে পারবেন। একজন মৌয়াল ১৪ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ কেজি মধু ও ১৫ কেজি মোম আহরণ করতে পারবেন। টানা ১৪ দিনের বেশি কোনো মৌয়াল সুন্দরবনে অবস্থান করতে পারবেন না।