সুন্দরবনের গাছে গাছে ফুল, মৌমাছির গুঞ্জন

সুন্দরবনের গাছে গাছে এখন নানা ফুলের সমাহারছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের গাছে গাছে এখন ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ অবস্থা। যে গাছে চোখ যায়, সেখানেই ফুটে আছে ফুল। খলিশা, হরকোচা, গরান, কেওড়া থেকে শুরু করে জানা-অজানা বহু গাছে শোভা পাচ্ছে ফুল আর কুঁড়ি।

বুধবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদী ধরে সুন্দরবনে ঢুকে দেখা যায়, ফুল ফুটে আছে সারি সারি খলিশা, গরান, পশুরসহ নানা জাতের গাছে। কেওড়াগাছে এসেছে ফুলের কুঁড়ি। ফুল ফোটায় কাঁটাযুক্ত হরকোচাও যেন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। গাছে গজানো নতুন পাতা ও বাহারি শ্বাসমূলে সুন্দরবনে যেন নতুন প্রাণের স্পন্দন। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বেড়ে গেছে মৌমাছিদের ওড়াউড়ি। এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ‘গুন গুন’ করে উড়ে বেড়াচ্ছে মৌমাছির দল।

কয়েকজন মৌয়ালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ফুলের মধু আসে। এর ২০-২৫ দিন পর আসে গরান ফুলের মধু। শেষে আসে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও দামি হচ্ছে খলিশার মধু। মৌসুমের প্রথম ফুলের মধু যা দেখতে সাদা, গাঢ় ও অনেক বেশি মিষ্টি। তবে বৃষ্টি না হলে ফুল শুকিয়ে ঝরে যায়, মধু জমে না। এ বছর তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত মধু না পাওয়ার শঙ্কা আছে।

এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ‘গুন গুন’ করে উড়ে বেড়াচ্ছে মৌমাছির দল
ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মূলত সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের মৌসুমের আগে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে গাছে ফুল ফোটার পরিমাণ কমে যায়। আবার ফুল ফুটলেও অনেক ফুল দ্রুত ঝরে যায়। এ কারণে ফুল থেকে মৌমাছি আগের মতো মধু আহরণ করতে পারে না।

বন বিভাগ আগামী ১ এপ্রিল থেকে মৌয়ালদের সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি দেবে। সেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন মৌয়ালরা। বুধবার সুন্দরবন–সংলগ্ন কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া, কয়রা ও কপোতাক্ষ নদের পাড়ের গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, মৌয়ালরা তাদের নৌকাগুলো নদীর তীরে সার করে বেঁধে রেখেছেন। অনেকেই শেষ সময়ে নৌকা মেরামতের কাজ করছেন।

সুন্দরবনের জানা-অজানা বহু গাছে শোভা পাচ্ছে ফুল আর কুঁড়ি
ছবি: প্রথম আলো

কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কথা হয় মৌয়াল আবুল হাসান গাজীর (৪০) সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁরা দলবেঁধে মধু সংগ্রহে যান। মৌসুমের দুই মাস মধু আহরণ করতে গিয়ে একেকজন মৌয়ালের ১৭ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। শুরুতে মধু একটু কম হয়। গত বছর তিনি ৩২ হাজার টাকা মণ দরে মধু বিক্রি করেছিলেন। এবার কেমন হবে, তিনি বুঝতে পারছেন না।

সুন্দরবনে ফোটা ফুল শুধু প্রকৃতিতে শোভা বাড়াচ্ছে, এমন না; মৌয়ালদের মনে আশার সঞ্চার করছে। এমনই এক মৌয়াল সুন্দরবন–সংলগ্ন দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, এখন বনের গাছে ফুল ফুটে গেছে। বাঘ, সাপ, কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে ১৭ বছর ধরে তিনি সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করেন। বেশি মধু না পেলে ভালো, নইলে ঋণের বোঝা টানতে হবে, এমনটাই বললেন তিনি।

মধু আহরণের মৌসুমের আগে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে মধু কমবেশি হওয়া অনেকটা বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। আগামী ১ এপ্রিল সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ শুরু হয়ে চলবে ৩১ মে পর্যন্ত। তবে অনুমতি পাওয়া মৌয়ালেরা মধু আহরণের জন্য মৌমাছি তাড়াতে আগুন, মশাল বা অনুরূপ কোনো দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করতে পারবেন না। এ নির্দেশনা অমান্য করলে শাস্তির বিধান আছে।

আগামী ১ এপ্রিল সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ শুরু হয়ে চলবে ৩১ মে পর্যন্ত
ছবি: প্রথম আলো