তিন ভাইয়ের আলাপে নরসুন্দর জীবনের সেকাল-একাল

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ঘাগড়া গোপালপুর গ্রামের বাজারে সড়কের পাশে নরসুন্দরের কাজ করেন তিন ভাইছবি: প্রথম আলো

প্লাস্টিকের মোড়া পেতে এক সারিতে পাশাপাশি বসে আছেন তিন ভাই। অপেক্ষা, কেউ আসবেন চুল কিংবা দাড়ি কাটতে। কিন্তু তাঁদের কাছে চুল কিংবা দাড়ি কাটানো মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে যা কামাই করেন, তাতে টেনেটুনে দিন যাচ্ছে নরসুন্দর তিন ভাইয়ের। অথচ কয়েক দশক আগেও কাজের চাপে মানুষকে দাঁড় করিয়ে রেখেও চুল–দাড়ি কেটে দিতে পারতেন না। আর এখন দীর্ঘ অপেক্ষায় মেলে না ভোক্তা।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের ঘাগড়া গোপালপুর গ্রামের প্রয়াত হরিন্দ্র চন্দ্র শীলের ছয় ছেলের মধ্যে ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল (৭০), হীরেন্দ্র চন্দ্র শীল (৬৫) ও রবীন্দ্র চন্দ্র শীল (৬০) নরসুন্দরের কাজ করেন। এই তিন ভাই রাজীবপুর ইউনিয়নের শাহগঞ্জ বাজারের পাশে পাশাপাশি বসে কয়েক দশক ধরে নরসুন্দরের কাজ করছেন। একসময় এখানে ১৫ থেকে ২০ জন নরসুন্দর থাকলেও রাস্তার পাশে এখনো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা।

গতকাল রোববার বেলা তিনটার দিকে কথা হয় নরসুন্দর তিন ভাইয়ের সঙ্গে। বেলা আড়াইটার দিকে বসলেও সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কোনো কাজ পাননি তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে সবার বড় ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীলের দুই পাশে অন্য দুই ভাই বসেছেন। বর্গাচাষি তিন ভাইয়ের ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। অন্যের জমি বর্গা করে সেখানে কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাহগঞ্জ বাজারের পাশে রাস্তায় বসে নরসুন্দরের কাজ করেন তাঁরা।

চার ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ধীরেন্দ্র। বয়স হলেও তিনি এখনো বাজারে এসে কাজের জন্য বসে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে এখানে এসে বসে থাকেন, যদি কাজ পান এই আশায়। এক-দুইটা শেভ করলে পকেট খরচটা চলে কোনো মতন। উপার্জন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মানুষ আধুনিক সেলুনে চলে যান, রাস্তায় বসে কেউ কাজ করতে চান না। সেলুন দেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই। বয়স্ক কেউ এলে রাস্তায় বসে কম খরচে কাজ করিয়ে যান। ৩০ বছর আগেও কাজের চাপে তাঁদের তিন ভাইয়ের অস্থির অবস্থা ছিল।

তিন ভাইয়ের আরেক ভাই হীরেন্দ্র চন্দ্র শীলের দুই মেয়ে ও তিন ছেলে। তিনি বলেন, ১৩ বছর বয়সে তিনি এই পেশায় আসেন। তখন চার পয়সায় শেভ, ১২ পয়সায় চুল কাটা হতো। আর এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় চুল কাটেন এবং ১০ টাকায় দাড়ি কাটেন। গত ২০ বছর ধরে তাঁদের কাছে আসা ভোক্তার সংখ্যা কমে গেছে। এখন দিনে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাঁর। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত কাজের আশায় এখানে বসে থাকেন। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু তাঁদের আয় কমেছে। তাই কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে তাঁর। এই বয়সে অন্য কোনো কাজ করবেন, সে উপায়ও নেই।

তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট রবীন্দ্র চন্দ্র শীলের দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে আলাদা থাকেন। তাই স্ত্রীকে নিয়ে নিজের সংসার তাঁর। তিনি বলেন, তাঁদের কিছু পুরোনো গ্রাহক আছেন। তাঁদের বাইরে কেউ চুল–দাড়ি কাটাতে আসেন না। দিনে তিনি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা উপার্জন করতে পারেন। এ দিয়েই চলে সংসার। আগে অনেকে তাঁদের মতো রাস্তায় বসে কাজ করলেও এখন ঘর নিয়ে সেলুন দিয়েছেন। তাঁরা তিন ভাই পথেই পড়ে আছেন। তাঁদের মৃত্যুর পর হয়তো আর কেউ এভাবে রাস্তায় বসে চুল–দাড়ি কাটাবে না।