রাজশাহীর ‘মরণ রাস্তার’ মোড়ে ঘন ঘন দুর্ঘটনা
রাজশাহী নগরের ছোট বনগ্রাম এলাকার একটি মোড়ের নাম ‘বারো রাস্তার মোড়’। চারটি বড় সড়ক ওই মোড়ে মিলিত হয়েছে। ঘন ঘন দুর্ঘটনা হয় বলে এলাকাবাসী মোড়টির নাম দিয়েছেন ‘মরণ রাস্তার’ মোড়। গত এক মাসে সেখানে ছোট-বড় অন্তত ১০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত সোমবার ওই মোড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নিহত হয়েছেন।
স্থানীয় এলাকাবাসী মোড়টিতে দ্রুত গোলচত্বর করার দাবি জানিয়েছেন। এ দাবিতে গত শুক্রবার মানববন্ধনও করেন তাঁরা। মোড়ে দুর্ঘটনার একাধিক ছবি দিয়ে সেই কর্মসূচির ব্যানার, বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার ছবি দিয়ে ফেস্টুন বানিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবির মুখে শনিবার থেকে মোড়ে একজন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যকেও রাখা হয়। এসবের মধ্যেই সোমবার দুর্ঘটনার শিকার হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পুরনজিত মহলদার। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
মোটরসাইকেলে করে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন পুরনজিত হালদার। পথে সড়কের ওপর রাখা বালুর সঙ্গে স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়ে তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। এর আগে গত ৩০ ডিসেম্বর সেখানে দুর্ঘটনার শিকার হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হাসান আহমদ। তিনি ওই রাস্তা দিয়ে মোহনপুরে যাচ্ছিলেন। তাঁর চোখের পাতার ওপর ৯টি সেলাই পড়েছে। শরীরে এখনো ব্যথা আছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। একটি ট্রাক এসে তাঁর মাইক্রোবাসে ধাক্কা দিয়েছিল।
অধ্যাপক হাসান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই রাস্তায় খুব বেশি গাড়ি চলে না। মোড়টা ভিজিবল নয়। একদিকের গাড়ি অন্যদিকে দেখা যায় না। এ জন্য বোধ হয় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। ওই মোড়ে দ্রুত কোনো সিস্টেম ডেভেলপ করা দরকার। পাশাপাশি একজন নয়, অন্তত দুজন ট্রাফিক পুলিশ দেওয়া দরকার।’
গত সেপ্টেম্বরে একই জায়গায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী মন্ডল। গাড়ির ক্ষতি হলেও শারীরিকভাবে তিনি আহত হননি। তিনি বলেন, ওই মোড়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। ওখানে খুব দ্রুতই কিছু একটা করতে হবে।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ওই মোড়ে গত এক মাসে অন্তত ১০টি ছোট–বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালান চালকেরা। রাত-দিন বালুর ট্রাক চলে। এলাকার রাস্তাজুড়ে বালুর স্তূপ আছে। এসবের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
ওই মোড়ের পাশেই নগরের চন্দ্রিমা থানা। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ওই মোড়ে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে এলাকাবাসী সেখানে গোলচত্বর করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের দাবির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে বারো রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল মো. তোফাজ্জল। তিনি বলেন, ‘এ রকম মোড় চাকরিজীবনে আর একটিও দেখিনি।’ সরেজমিনে রাস্তাজুড়ে বালু পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সোনা চন্দ্র দাস বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে ভয় করে। চোখের সামনে দুর্ঘটনা ঘটছে। কতজন কতভাবে আহত হচ্ছে। কিন্তু মোড়টির কোনো মেরামত করছে না। এলাকার সবাই মানববন্ধন করায় একজন ট্রাফিক পুলিশ দিয়েছে। কিন্তু তিনি একা কী করবেন। এখানে গোলচত্বর হলে সব গাড়ি দেখা যাবে।’
মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার মো. নূর আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘ওই জায়গায় তো ট্রাফিক পুলিশ রাখাটাও ঝুঁকিপূর্ণ। ওখানে যেভাবে গাড়ি চলে, দেখা গেল যে সিগন্যাল না মেনে পুলিশের ওপর দিয়ে উঠিয়ে দিল।’ তিনি বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, স্থানীয় সড়ক বিভাগের নয়, সেটি সিটি করপোরেশন ও রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ)। এলাকাটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকির ব্যাপারে তিনি দায়িত্ব নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছেন। তিনিও মনে করেন, সেখানে গোলচত্বর করা যেতে পারে। তবে সেটি বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আহমদ আল মঈন বলেন, ‘আগের যাঁরা রোড ডিজাইন করেছেন, সেখানে কিছু জায়গায় কারেকশন করা দরকার। আমরা এটা করব।’ আরডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবদুল্লাহ আল তারিককে ফোন করা হলেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
শিক্ষার্থীবান্ধব ছিলেন পুরনজিত
দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষক পুরনজিত মহালদার শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় ও পরিচিত মুখ ছিলেন। শিক্ষার্থীদের স্নেহ করে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, পুরনজিত মহালদার খুবই শিক্ষার্থীবান্ধব ও প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিপদে পাশে দাঁড়াতেন।
সোমবার দুপুরে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বের হয়েছিলেন পুরনজিত মহালদার। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আর বাসায় ফেরা হয়নি। বারো রাস্তার মোড়ে বালুর ওপর স্লিপ খেয়ে একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খান। এতে মাথায় ও হাতে গুরুতর আঘাত পান। পরে তাঁকে আহত অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিন দিবাগত রাত ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র তিনি মারা যান।
পুরনজিত মহালদারের লাশ আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে আনা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। শিক্ষার্থীরাসহ অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁর মৃত্যুতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বন্ধুজন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে শোক প্রকাশ ও স্মৃতিচারণা করেছেন।
বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অর্বাক আদিত্য লিখেছেন, ‘ছাত্রদের বিপদের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হওয়া মানুষটাও চলে গেলেন। ক্যাম্পাস ছাড়ার পর একবারই কথা হয়েছে। অনেক জ্বালিয়েছি আপনাকে। ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগ হলো না। আমরা আপনাকে ভালোবাসি, স্যার। আপনারে মনে রাখব।’
পুরনজিতকে আইসিইউতে ভর্তির সময় বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আদিত্য রায় ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আমার এই পিতার প্রতি একটু সহায় হোন হে ঈশ্বর, একটু সদয় হোন।’ মারা যাওয়ার পর রিপন লিখেছেন, ‘আমার ঈশ্বর অত্যন্ত নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মম ও অবিবেচক। বিদায় পিতা...।’
এ ছাড়া একই বিভাগের শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল প্যানেলের ম্যাচ রেফারি সুপ্রিয়া রানী দাস, রেজিস্ট্রার ইফতিখারুল আলম মাসউদসহ অনেকেই তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন। পুরনজিতের মৃত্যুতে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন ও অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডে প্রয়াত শিক্ষকের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
পুরনজিত মহালদারের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামে। তিনি ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ২০২০ সালে সহযোগী অধ্যাপক হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘আহমদ ছফার কথাসাহিত্য’ শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থসহ তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। নিজ বাড়িতেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।