শেরপুরে ১৬৪ বছরের প্রাচীন ‘মাইসাহেবা মসজিদ’, নামাজ আদায় করেন নারীরাও

শেরপুরে অবস্থিত ১৬৪ বছরের প্রাচীন মাইসাহেবা মসজিদ। মঙ্গলবার তোলাছবি: প্রথম আলো

শেরপুরে ১৬৪ বছরের প্রাচীন মাইসাহেবা মসজিদটি জেলা শহরে নির্মিত প্রথম মসজিদ। মসজিদটি নির্মিত হয় ১৮৬১ সালে, এর অবস্থান শহরের তিনআনী বাজার (রাজাবাড়ী) এলাকায়।

ধর্মীয় অনুভূতি, প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীমণ্ডিত মসজিদটি বর্তমানে জেলার অন্যতম প্রধান মসজিদ। শেরপুর শহরে প্রবেশের সময় এর সুউচ্চ মিনার দুটি অনেক দূর থেকে দেখা যায়। বর্তমানে ৭৩ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদে প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন প্রায় তিন হাজার মুসল্লি। ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন শেরপুরে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রয়াত পণ্ডিত ফছিহুর রহমানের লেখা ‘শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান’ বই থেকে জানা যায়, শেরপুর শহরের ভেতরে নির্মিত প্রথম মসজিদ এটি। এটি তিনআনী জমিদারবাড়ির সন্নিকটে অবস্থিত। শেরপুরের শেরীপাড়ার মিঞা সাহেবদের পূর্বপুরুষ প্রয়াত সৈয়দ আব্দুল আলীর খালা ছিলেন প্রয়াত সালেমুন নেছা বিবি। শেরীপাড়ার মিঞা বংশের লোক পুরুষ হলে তাঁকে মিঞা আর মেয়ে হলে তাঁকে মাই সাহেবা বলা হতো। সে হিসেবে সালেমুন নেছা বিবিকেও মাইসাহেবা বলা হতো। তিনিই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তাঁরই নাম অনুসারে এই মসজিদকে মাইসাহেবা মসজিদ বলা হয়।

মাইসাহেবার (সালেমুন নেছা বিবি) নির্মিত আদি মসজিদটি ছিল ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের। তিন গম্বুজবিশিষ্ট সেই মসজিদের ছিল ৪০ ইঞ্চি পুরু ইট-সুরকির দেয়াল। এর দরজা ছিল পাঁচটি এবং দুটি কাতারে ১৮ জন করে ৩৬ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারতেন। মসজিদটি প্রতিষ্ঠার পর এই মহীয়সী নারীর কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বর্ধিত মুসল্লির চাপে মসজিদটি সম্প্রসারণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ জন্য প্রথম ১৯০৩ সালে ভবনটির সম্প্রসারণ করে আরও তিনটি কাতার বাড়ানো হয়।

২০০১ সালে মসজিদটি নতুনভাবে সংস্কার করা হয়। মঙ্গলবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

এদিকে মাইসাহেবা মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাচীন স্থাপত্যের সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে মসজিদটির সম্প্রসারণের জন্য শেরপুরের স্থপতি আব্দুল্লাহ ইবনে সাদিক একটি নকশা তৈরি করেন। সেই নকশা অনুযায়ী ২০০১ সালে নতুনভাবে শুরু করা হয় বর্তমান আধুনিক মসজিদটির নির্মাণকাজ। বর্তমানে চারদিকে সীমানাপ্রাচীরবেষ্টিত এই মসজিদে আছে আরবি ক্যালিগ্রাফিখচিত দুটি দৃষ্টিনন্দন প্রবেশপথ। এর প্রতিটিতে চারটি ছোট ও একটি করে বড় গম্বুজ আছে। এর বাইরের সৌন্দর্য যেকোনো পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। ৯৫ ফুট ও ৮৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন দুটি মিনার শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখা যায়।

তিনতলাবিশিষ্ট এই মসজিদের নিচতলা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। মসজিদের দোতলায় আছে হুজরাখানা, মুয়াজ্জিন ও ইমামের বাসস্থান। আছে পরিচ্ছন্ন দুটি অজুখানা ও এস্তেঞ্জাখানা। মসজিদের একজন ইমাম, একজন পেশ ইমাম, একজন মুয়াজ্জিন, একজন কম্পিউটার অপারেটর ও তিনজন খাদেম আছেন।

শেরপুর শহরে প্রবেশের সময় এর সুউচ্চ মিনার দুটি অনেক দূর থেকে দেখা যায়। মঙ্গলবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

শেরপুর শহরের বাগরাকসা এলাকার বাসিন্দা ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য মো. ইমাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই মসজিদে গড়ে তিন হাজার মুসল্লি তারাবিহ ও জুমার নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন প্রায় ছয় হাজার মুসল্লি এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন। নারীদের নামাজের জন্য আছে আলাদা ব্যবস্থা। প্রতি শুক্রবার দূরদূরান্ত থেকে অনেক মুসল্লি এই মসজিদে এসে জুমার নামাজে শরিক হন।

মাইসাহেবা মসজিদটি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। শেরপুর জেলা বিএনপির প্রবীণ নেতা আব্দুল আওয়াল চৌধুরী কমিটির সভাপতি এবং ফজলুল হক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আব্দুল আওয়াল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মাইসাহেবা মসজিদ শেরপুর জেলার ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই এই মসজিদে অর্থ দান করে থাকেন। সমাজের সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় বিত্তশালী মানুষের দান ও অনুদানের মাধ্যমে এই মসজিদের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। রমজান মাসে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মুসল্লি এ মসজিদে ইফতার করে থাকেন। ইফতারির খরচ মসজিদ কমিটির সদস্য ও জেলার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন।