ভবন নির্মাণে কাটা হলো ৯৭টি গাছ, পরিবেশকর্মীদের আপত্তি

চট্টগ্রামের বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণাগারের ভবন নির্মাণের জন্য কাটা গাছ ট্রাকে তোলা হচ্ছে। গতকাল বিকেলেছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রামের বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) আগর গবেষণাগারের ভবন নির্মাণের জন্য কাটা হয়েছে ছোট-বড় অন্তত ৯৭টি গাছ। এক সপ্তাহ ধরে গাছগুলো কাটা হয়েছে। গতকাল সোমবারও চলে গাছ কাটা।

এ নিয়ে পরিবেশকর্মীরা আপত্তি তুললেও বিএফআরআই তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছে। বিএফআরআই কর্তৃপক্ষের দাবি, গাছ কাটার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অনুমোদন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।

বিএফআরআই আগর গবেষণাগার করার জন্য ছয়তলার ভবন নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরের বিএফআরআইয়ের অভ্যন্তরে ৫৮ শতক জায়গায়। গবেষণাগার নির্মাণের জন্য ‘সম্পূর্ণ বৃক্ষে উন্নতমানের আগর রেজিন সঞ্চয়ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রকল্প’ নেওয়া হয়। বন বিভাগের দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি বিএফআরআই ও অপরটি বন অধিদপ্তর।

২০২১ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) পৌনে ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। এরপর নকশা দিয়েছে স্থাপত্য অধিদপ্তর। অনুমোদন রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের।

সরেজমিনে গতকাল বিকেলে দেখা গেছে, বিএফআরআই ফটকের পাশে টিনের ঘেরাও দিয়ে গাছ কাটার কাজ চলছিল। কাটার কাজ শেষ পর্যায়ে। একটি ট্রাকে কাটা গাছ ওঠানো হচ্ছে। শেষ প্রান্তে একটি বৈলামগাছ তখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। আরেকটি ইউক্যালিপটাসগাছের ডাল ছেঁটে গোড়া কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শ্রমিকেরা। ঘেরাওয়ের গায়ে প্রকল্পের ছবিসংবলিত একটি ব্যানার লাগানো হয়েছে।

ভবনটি নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট (পিডিএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ছয়তলা ভবনটি নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে ভবনের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পুরো গবেষণা প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুন মাসে।

গাছ কাটছেন এক শ্রমিক। গতকাল বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

প্রকল্প এলাকায় দেখা মিলল প্রকল্প পরিচালক বিভাগীয় কর্মকর্তা (মণ্ড ও কাগজ বিভাগ) মোহাম্মদ জাকির হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সব অনুমোদন নিয়েই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। যেসব গাছ কাটা হচ্ছে, এর বেশির ভাগ পরিপক্ব হয়েছে। ইউক্যালিপটাস, মেহগনিজাতীয় গাছ বেশি। এই গাছের বদলে আমরা অনেকগুলো গাছ লাগাচ্ছি বিভিন্ন স্থানে। এখানেও বর্ষা মৌসুমে লাগাব। এই ধরনের গবেষণাগার বিএফআরআইতে নেই। এটা খুব দরকারি।’

বন বিভাগ যদি নিজেরা গাছ কাটে, তখন সাধারণ মানুষ কি এতে উৎসাহিত হবে না—এমন প্রশ্নে জাকির হোসাইন বলছিলেন, ‘এই গাছগুলোর বিপরীতে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আগরবাগান রয়েছে আমাদের। কিন্তু গবেষণাগারের জন্য ঢাকায় দৌড়াতে হয়।’

প্রকল্পটির নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে সময় লেগেছে আরও এক বছরের বেশি। এরপর বিএফআরআইয়ের সাবেক পরিচালক রফিকুল হায়দার প্রকল্পের জায়গা বুঝিয়ে দিতে দেরি করেন। তাঁর আপত্তির মূল কারণ প্রকল্প এলাকার গাছগুলো। অবশেষে ২০২৩ সালের ৪ জুলাই প্রকল্পের জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই বছরই স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে প্রকল্পটির নকশা পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অনুমোদন মেলে।

২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর বিএফআরআইয়ের বিভাগীয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) মো. মাহবুবুর রহমান প্রকল্পের গাছ কাটার অনুমোদনের জন্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ বরাবর আবেদন করেন। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর উত্তর বন বিভাগ ফিরতি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে গাছ কাটার অনুমোদন তারা দেয়নি। তারা কেবল গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে দেয়।

কেটে ফেলা গাছ। গতকাল বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম কায়চার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গাছ কাটার কোনো অনুমোদন দিইনি। শুধু দণ্ডায়মান ৭৭টি গাছের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছি। তাদের বলা হয়েছে, গাছ কাটার জন্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ কমিটির অনুমোদন নিয়ে তা জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিতে প্রেরণ করার জন্য। ওই কমিটির সদস্যসচিব আমি। আমরা সে রকম কিছু পাইনি।’

উত্তর বন বিভাগ থেকে গাছ কাটার অনুমোদন না পেয়ে প্রকল্প পরিচালক বিএফআরআইয়ের ‘পরিপক্ব, মরা গাছ কর্তন, গাছ রক্ষণাবেক্ষণ’ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে বিষয়টি অনুমোদনের জন্য পাঠায়। ৯ সদস্যের ওই কমিটির আহ্বায়ক বিএফআরআইয়ের বিভাগীয় কর্মকর্তা (সিলভিকালচার রিসার্চ) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তাঁরা এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসেন।

আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে এত বড় বড় গাছের বিষয়টি নেই। আমরা কেবল ছোটখাটো মরা গাছ কিংবা বাঁকা গাছ কাটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারি। তাই এই বিষয়টিতে আমরা পজিটিভ কোনো সিদ্ধান্ত দিইনি।’

জেলা বন ও পরিবেশ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিতেও গাছ কাটার অনুমতির জন্য আর পাঠানো হয়নি। পরে গাছ কাটার অনুমোদনের জন্য বিএফআরআইয়ের পক্ষ থেকে তাঁদের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সাত সদস্যের অপর একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির আহ্বায়ক বিএফআরআই বন রক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আহসানুর রহমান। সদস্যসচিব করা হয় ইনভেনটরি বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রবিউল আলমকে। এই কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি সভা করে গাছ কাটার অনুমোদন দেয়। এরপর দরপত্র আহ্বান করা হয়। পরে ৩ মার্চ গাছ কাটার কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য আহসানুর রহমান ও রবিউল আলমকে ফোন করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে প্রকল্প পরিচালক জাকির হোসাইন বলেন, জেলা প্রশাসকের কমিটিতে এটা না দিয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এই কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি গাছ কাটার বিষয়টি অনুমোদন দেওয়ার পর কাজে হাত দেওয়া হয়।

কাটা পড়েছে যেসব গাছ

৯৭টি গাছের মধ্যে ২০টি হেলে পড়া এবং মরা ছিল। ফলে দণ্ডায়মান ৭৭টি গাছের মূল্য নির্ধারণ করে কাটার কার্যাদেশ দেওয়া হয় ৩ মার্চ। অপ্সরী টিম্বার নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় এসব গাছ কিনে নেয়।

৭৭ গাছের মধ্যে ইউক্যালিপটাস ৩০টি, মেহগনি ১১টি, তেলসুর ৬টি, ঢাকিজাম ১৩টি, কদম ৩টি, রক্তন ৪টি, জারুল ৪টি, বক্স বাদাম ২টি রয়েছে। এ ছাড়া ১টি করে জংলি বাদাম, কাঁঠাল, কৃষ্ণচূড়া ও ছাতিমগাছ রয়েছে। ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সী গাছ এখানে রয়েছে।

উত্তর বন বিভাগের নির্ধারণ করে দেওয়া দর অনুযায়ী এসব গাছ থেকে ২ হাজার ৩০৯ ঘনফুট কাঠ পাওয়া যাবে। জ্বালানি কাঠ মিলবে ৬৪৭ ঘনফুট। বল্লি কাঠ পাওয়া যাবে ২৮ ফুট।

সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রিতু পারভীন গতকাল প্রকল্প এলাকায় গিয়ে গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানান। রিতু পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিডি (প্রকল্প পরিচালক) কোনোভাবেই কাজ বন্ধ করছেন না। এতগুলো গাছ কেটে ফেলেছে। বন রক্ষক যদি গাছ ধ্বংস করে, আমরা যাব কোথায়? আমরা এর প্রতিবাদে কর্মসূচি দেব।’