ক্ষমতার পালাবদলে পুড়ল কারখানা, বেকার হলেন দেড় হাজার শ্রমিক
প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালন করছেন দুজন নারী শ্রমিক। ফটকটি পার হতেই অদূরে মাদুর বিছিয়ে বসে আছেন প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শ্রমিক-কর্মকর্তা। কিছুক্ষণ পরপর চারপাশে ঘুরে খোঁজখবর নিচ্ছেন। সবার চোখেমুখে অজানা দুশ্চিন্তা। কবে নাগাদ চালু হবে তাঁদের প্রতিষ্ঠানটি, কেউ বলতে পারছেন না।
রাজবাড়ীর শতভাগ উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গোল্ড এশিয়া জুট মিলে গত বুধবার সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে। শহরের পাশে রামকান্তপুর ইউনিয়নের কাজীবাধা গ্রামে নির্মিত এই কারখানার মালিক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ৫ আগস্ট বিকেলে দুর্বৃত্তরা জুট মিলের ফটকে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর করে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে পুরো মিল জ্বালিয়ে দেয়। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। প্রাথমিকভাবে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তাঁদের ধারণা।
বুধবার গোল্ড এশিয়া জুট মিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের ভেতরে বাঁ পাশে চারটি কঙ্কালসার গাড়ি। পাশে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ভাঙচুর করা হলেও আগুন দেয়নি। পোড়া একটি ভবনের নিচে মাদুর বিছিয়ে বসে আছেন হিসাবরক্ষক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন। বিশাল আকারের চারটি শেড পুড়ে কঙ্কালসার হয়ে ধসে পড়েছে। ভেতরে দামি দামি যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ধ্বংসযজ্ঞের ১০ দিন পরও সুতার স্তূপ থেকে আগুন বের হচ্ছে। ৫ আগস্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময় বিষ দিয়ে কারখানার পুকুরের মাছ লুট করা হয়। বাকি মাছগুলো মরে আছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৫ সালে প্রায় ১০ একর জমির ওপর এই কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে জুট ইয়ার্ন ও জুট ব্যাগ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। দুটি বিভাগে প্রায় ১ হাজার ১০০ শ্রমিক কাজ করতেন। পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ, নিরাপত্তাকর্মী, মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক বিভাগ ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে কর্মরত ছিলেন আরও প্রায় ৪০০ জন। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এই কারখানায় কাজ করতেন।
৫ আগস্ট ধ্বংসযজ্ঞের সময় জুট মিলের দুটি গোডাউনে প্রায় ১৬ কোটি টাকার ৫০ হাজার মণ কাঁচা পাট, জুট ইয়ার্ন ও টুইয়ানে ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন পাটের সুতা ছিল। জুট ব্যাগ ও ক্লথে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন সুতা, প্রক্রিয়াজাতকরণে ৪০০ টন সুতা এবং আরও প্রায় ৪৫০ টন পাট রাখা ছিল। শ্রমিকদের আনা–নেওয়ার জন্য তিনটি গাড়ি এবং পণ্য পরিবহনের জন্য তিনটি গাড়ি ছিল। ধ্বংসযজ্ঞে সব পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে।
৫ আগস্ট কারখানায় কাজ করছিলেন সিনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নিপুর আহম্মেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকেল ৫টার দিকে অতর্কিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর করে গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। চোখের সামনে ভাঙচুর করে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। আমরা প্রাণভয়ে সবাই নিরাপদ স্থানে চলে যাই।’
মিলের বৈদ্যুতিক শাখায় ছিলেন রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মিলে কাজ করেছি। আমার জীবনে এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখিনি। মিলটি পুড়ে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে মানবেতরভাবে দিন পার করছি। মিলটি চালু হলে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক পরিবার বেঁচে যাবে।’
মৌসুমী আক্তার নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার টাকা পেতাম। এই টাকা দিয়ে ঋণের কিস্তি চালাতাম, সংসার চালাতাম। এখন কী খাব, কীভাবে চলব, কোনো কিছু ভেবে পাচ্ছি না।’
কারখানাটিতে বছরে ১০০ কোটি টাকার ওপর টার্নওভার হতো বলে জানান প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা দেবাশীষ ভক্ত। তিনি বলেন, দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট করে মিলের প্রতিটি কোনায় গানপাউডার ও পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। নগদ ৫০ লাখ টাকাসহ প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মিলের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে এখন কষ্টে দিন পার করছেন।
মালিকদের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ
কারখানার পরিসর বড় করার সময় অবৈধভাবে ভূমি দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় কয়েকজন। প্রতিকার চেয়ে কাজীবাধা গ্রামের আবদুস ছালাম শেখ বাদী হয়ে গত ১৪ আগস্ট ৫৪ জন স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্র সেনা ক্যাম্পসহ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও প্রেসক্লাবে দিয়েছেন।
ছালাম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আবাদকৃত জমি ছিল। আমিসহ অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরিত অনেকের জমি রয়েছে। কাজী ইরাদত আলী ও তাঁর লোকজন অবৈধভাবে দখল করেছেন। আমরা এত দিন ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।’
কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ইরাদত আলী অসুস্থ থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। প্রশাসনিক কাজ দেখভাল করেন তাঁর পুত্রবধূ আফসানা নওমী। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় ৫ আগস্ট দুর্বৃত্তরা আমার শ্বশুরের বাড়িসহ জুট মিলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আগুন দিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। পুনরায় মিল চালুর ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কবে নাগাদ চালু করতে পারব বলতে পারছি না।’
স্থানীয় লোকজনের জমি দখলের বিষয়ে আফসানা নওমী বলেন, কারখানাটি বর্ধিতকরণে কিছু জায়গা কেনা হয়েছে। অনেকের টাকা দেওয়া হয়েছে, কিছু টাকা বাকি আছে। প্রত্যেকের টাকা পরিশোধ করে জমি রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। কারও জমি জোরপূর্বক নেওয়া বা দখল করার অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। কাজী ইরাদত আলীসহ কাজী পরিবার সব সময় দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। দেশে এমন পরিস্থিতিতে অনেকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন।