গ্রামের লোকজন বলে, এত পড়ে কী হবে, বিয়ে কবে হবে
দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগে ২০১৭ সালে মারা যান বাবা মো. ইমতিয়াজ আলী। মোসাম্মৎ তাবাসসুম আক্তার তখন এসএসসি পাসের পর সবে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। এরপর মা মোসাম্মৎ আম্বিয়া খাতুন কখনো ডিম বিক্রি করে, কখনো রাজহাঁসের বাচ্চা বা গরুর দুধ বিক্রি করে তাবাসসুমের পড়ার খরচ জোগাচ্ছেন। হাওরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় যেখানে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহ সাধারণ ঘটনা, সেখানে তাবাসসুম এখন স্নাতক (পাস) শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ জন্য প্রতিনিয়ত তাঁকে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়নের দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন গ্রাম গোড়াদিঘার বাসিন্দা তাবাসসুম (২৩)। ঘোড়াউতড়া নদীর পাশে অবস্থিত গ্রামটিতে চার হাজারের বেশি অধিবাসী রয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে মাত্র পাঁচটি মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের একজন তাবাসসুম।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন তৈরির কাজে গোড়াদিঘায় গিয়ে দেখা হয় তাবাসসুমের সঙ্গে। এলাকায় তিনি লতিফা নামে পরিচিত। টানাটানির সংসারে জোড়াতালি দিয়ে চলছে তাঁর পড়াশোনা। তাবাসসুমের কথায়, যেখানে ৩০ টাকা খরচ লাগে, সেখানে তাঁরা ১০ টাকা খরচের চেষ্টা করেন। বাজারের সবচেয়ে কম দামের সবজি কেনেন।
মায়ের কারণেই এতটা এসেছি। মায়ের কারণেই পড়ি। আমার মা গ্রামের অন্যদের মতো নন। যদি বলি এত অনটনের মধ্যে কষ্ট করে আর পড়ব না। মা বলেন, তিনি খরচ চালাবেন। কিন্তু মায়ের বয়স এখন ৬৫ বছরের ওপরে। মায়ের ওপর এখন চাপ হয়ে যায়। আরেকটি চাকরি খোঁজার চেষ্টায় আছি।
হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোর মধ্যে তাবাসসুমদের গ্রামটি আরও দুর্গম। চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত দুটি বিদ্যালয় থাকলেও কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর পড়তে চাইলে শিক্ষার্থীদের ঘোড়াউতড়া ও ধনু নদ পেরিয়ে দামপাড়া ইউনিয়নের আলিয়াপাড়া গ্রামে যেতে হয়। সেখানে এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয় নামে একটি এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় আছে। পথের কষ্টসহ দৈনিক যাতায়াতের খরচ ৮০ টাকা হওয়ায় মাসে ৭ থেকে ৮ দিনের বেশি গোড়াদিঘার শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যায় না।
তাবাসসুম পাঁচজনের একজন
আলিয়াপাড়ার এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গোড়াদিঘা গ্রামের বাসিন্দা রুবেল আহমেদ বলেন, গ্রামে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই বলে পঞ্চম শ্রেণির পর অনেক প্রতিকূলতা ঠেলে শিক্ষার্থীদের অন্য গ্রামে গিয়ে পড়তে হয়। যাতায়াতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে। এ ছাড়া খরচও হয় অনেক। গ্রামটিতে অভাবী লোকই বেশি। তাঁরা এত খরচ চালাতে পারেন না। এ কারণে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি মেয়ে টিকে থাকে।
বিভিন্ন বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করা গোড়াদিঘার মাত্র পাঁচটি মেয়ে এখন স্নাতকে (সম্মান ও পাস কোর্স) পড়ছেন উল্লেখ করে রুবেল আহমেদ বলেন, তাঁদের মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়েছে। এ পাঁচজনই তাঁর ছাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তাবাসসুম একজন। অন্যরা হচ্ছেন সিমলা, তনিমা, রুকাইয়া ও পপি।
গোড়াদিঘা গ্রাম থেকে ৮০ জনের মতো ছাত্রছাত্রী এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ছে। ২০ জন পড়ছে সিংপুর ইউনিয়নের টেংগুরিয়ায় হাজী আহমদ আলী দাখিল মাদ্রাসায়। আসন্ন শুকনা মৌসুমে এই শিশুদের অনেকে ঝরে পড়বে। মা–বাবা সন্তানদের নিয়ে শহরে ইটভাটায় কাজ করতে চলে যাবেন। অনেক শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়াও হবে না।
তাবাসসুম গোড়াদিঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ২০১২ সালে এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজে। ওই বছর বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে সাময়িক অসুবিধায় পড়েন। দুই বছরের বিরতির পর ২০২১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এখন স্নাতক (পাস) প্রথম বর্ষের ছাত্রী তিনি। পড়ছেন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজে।
গোড়াদিঘা গ্রামে এমএ পাস কোনো নারী নেই জানিয়ে রুবেল আহমেদ বলেন, পুরুষদের মধ্যে তাঁরা তিন ভাই কেবল এমএ পাস করেছেন। তিনি আরও বলেন, গোড়াদিঘা গ্রাম থেকে ৮০ জনের মতো ছাত্রছাত্রী এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ছে। ২০ জন পড়ছে সিংপুর ইউনিয়নের টেংগুরিয়ায় হাজী আহমদ আলী দাখিল মাদ্রাসায়। আসন্ন শুকনা মৌসুমে এই শিশুদের অনেকে ঝরে পড়বে। মা–বাবা সন্তানদের নিয়ে শহরে ইটভাটায় কাজ করতে চলে যাবেন। অনেক শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়াও হবে না।
‘মায়ের কারণে পড়ি’
তাবাসসুমেরা পাঁচ বোন ও চার ভাই। বর্তমানে গ্রামে তিনি, মা ও ছোট একটি বোন থাকেন। বিয়ের পর বাকি ভাই-বোন আলাদা সংসারে আছেন। ছোট বোনটি পঞ্চম শ্রেণির পর পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে।
তাবাসসুম জানান, বাবা কৃষিজীবী ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরও তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পেরেছেন মায়ের কারণে। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে তাবাসসুমদের কৃষিজমি বর্গাচাষিদের দেন। এর বিনিময়ে পাওয়া টাকা দিয়ে সারা বছর চলতে হয় তাঁদের। পাশাপাশি মা কয়েকটি মুরগি পোষেন। সেগুলোর ডিম বিক্রি করেন। ছয়টি রাজহাঁস আছে। এগুলোর বাচ্চা বিক্রি করেন। তিনটা গরু আছে। দুধ বিক্রি করেন।
তাবাসসুম বলেন, ‘মা আমাকে এভাবে অনেক কষ্টে পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন। এসএসসি পাস করেছি বাণিজ্য বিভাগ থেকে। এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছি, যাতে কোচিং করা না লাগে। নিজে নিজে যেন পড়তে পারি।’
তাবাসসুম একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সচেতনতামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন।
গোড়াদিঘা গ্রামের ৩০ কিশোরীকে নিয়ে বাল্যবিবাহ, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন পরির্বতন বিষয়ে সচেতনতার কাজ করতেন। তাবাসসুমের পদের নাম ছিল ‘অ্যানিমেটর’। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সাত মাস ছিল তাঁর চাকরির মেয়াদ। মাসে দেড় হাজার টাকা করে পেতেন। এটা দিয়ে তাঁর পড়ালেখা ও হাতখরচ চলত। চলতি মাস থেকেই সমপরিমাণ অর্থের ঘাটতি সামলে চলতে হবে তাঁকে।
তাবাসসুম বলেন, ‘মায়ের কারণেই এতটা এসেছি। মায়ের কারণেই পড়ি। আমার মা গ্রামের অন্যদের মতো নন। যদি বলি এত অনটনের মধ্যে কষ্ট করে আর পড়ব না, মা বলেন, তিনি খরচ চালাবেন। কিন্তু মায়ের বয়স এখন ৭০ বছরের ওপরে। মায়ের ওপর এখন চাপ হয়ে যায়। আরেকটি চাকরি খোঁজার চেষ্টায় আছি।’
চাকরি করলে পড়াশোনায় কীভাবে সময় দেবেন জানতে চাইলে তাবাসসুম বলেন, ‘চাকরি তো দিনের বেলা। রাতে পড়ব। কলেজের স্যারকে আমার সমস্যার কথা জানিয়েছি। বলেছি, নিয়মিত ক্লাস করতে পারব না। আমাকে চাকরি করে পড়তে হবে। স্যার রাজি হয়েছেন।’
বিয়ে নিয়ে লোকজন নানা কথা শোনায়
নানা প্রতিকূলতা ঠেলে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তাবাসসুমকে প্রায়ই গ্রামের কিছু মানুষের কথা শুনতে হয়। ‘এই বয়সেও কেন বিয়ে হচ্ছে না’—এ নিয়ে মা-মেয়েকে কথা শোনান গ্রামের কিছু মানুষ। তাবাসসুম বলেন, ‘সমাজের অনেকে খারাপ কথা বলে। বিয়ে নিয়ে লোকজন নানা কথা শোনায়। এত বয়সে বিয়ে হয়নি কেন জানতে চায়। জিজ্ঞাসা করে, এত পড়ে কী হবে? বিয়ে হবে কবে?’
তাবাসসুম জানান, আদালতে কালো কোট পরা নারীদের দেখে তাঁর আইনজীবী হওয়ার খুব শখ ছিল। কিন্তু এলএলবিতে ভর্তি হতে পারেননি। সাংবাদিক হওয়ারও শখ ছিল। এখন পড়ালেখা শেষ করে যেকোনো একটি শোভন চাকরি করতে চান, যাতে নিজে ক্ষমতায়িত হতে পারেন। মা ও ছোট বোনকে দেখভাল করতে পারেন।