পুনরায় দখল–দূষণের কবলে দিনাজপুর শহরের ঘাগড়া খাল
উচ্ছেদ হওয়া স্থানে পুনরায় বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। খালে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
দিনাজপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী ঘাগড়া খালের পাড় ঘেঁষে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও সংস্কারকাজ করা হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে। উচ্ছেদ ও সংস্কারকাজ শেষে খালের উভয় পাড়ে লাগানো হয়েছিল বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ। খালের স্বচ্ছ পানিতে দেখা মিলেছিল বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছের।
কিন্তু সেই খাল আগের অবস্থায় ফিরে যেতে শুরু করেছে। খালে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। উচ্ছেদ হওয়া স্থানে পুনরায় বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অস্তিত্ব নেই খালের উভয় পাড়ে লাগানো এক তৃতীয়াংশ গাছপালার। সামনে বর্ষা মৌসুমে পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে—এমন আশঙ্কা শহরবাসীর।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দিনাজপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘাগড়া খালের দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৫৫-৬০ ফুট। খালটি দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর বাস টার্মিনালের উত্তর দিকের নিচু এলাকা থেকে শুরু হয়ে বালুবাড়ি, চুড়িপট্টি, বাঞ্ছারামপুর, বড়পুল, কসবা, ঘুঘুডাঙ্গা হয়ে পুনর্ভবা নদীতে মিশেছে।
মেহেরাব আলীর দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-৫ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে তৎকালীন মহারাজা গিরিজানাথের মা শ্যামামোহিনী বর্ষাকালে শহরের ময়লা-আবর্জনা উপচে পড়ে শহর প্লাবিত হওয়া প্রতিরোধ করা ও মশাবাহিত রোগ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ঘাগড়া খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মহারাজা গিরিজানাথ পরিকল্পিতভাবে পুনরায় খালটির খননকাজ করেন।
অন্যরা বাড়িঘর করেছে। জায়গাটা ফাঁকা আছে তাই আমরাও করেছি। সরকার চাইলে যেকোনো সময় ভেঙে ফেলব।
সময়ের পরিবর্তনে দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে ঘাগড়া খাল। খাল দখল করে কেউ তুলেছিলেন দেয়াল, কেউ পাকাঘর, কেউ বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি অফিসের দেয়ালও উঠেছে খালের ওপর। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই জেলা শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে শুরু করে। এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘সংকটে ঘাগড়া ও গিরিজা খাল, দখলে সরকারি প্রতিষ্ঠানও’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই বছর ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসন পাউবো ও পৌরসভার সঙ্গে সমন্বয় করে খাল খনন ও উচ্ছেদ কাজে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তখন প্রাণনাথপুর, বালুবাড়ি, খামার কাচাই, উত্তর ফরিদপুর, খামার ঝাড়বাড়ী, পাহাড়পুর, কসবা ও কাঞ্চন মৌজায় ৪৩৮ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি করে। খালের জায়গায় ৬৩টি সেমিপাকা বাড়ি, ১০৬টি টিনশেড ঘর, ৪টি দ্বিতল ভবন ও একটি একতলা ভবনের তালিকা প্রস্তুত করে এবং ২৪ ডিসেম্বর উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখা যায়, শহরে খালের উভয়পাড়ে অবস্থিত বাসাবাড়ির ময়লা–আবর্জনা পাইপের মাধ্যমে খালে গিয়ে পড়ছে। হোটেল–রেস্তোরাঁসহ বাসাবাড়ির ময়লা ফেলায় খালটি ভরাট হতে শুরু করেছে। কালো ময়লা পানিতে উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। মহারাজা বটতলী মোড়ে প্রধানসড়কে কালভার্টের মুখ ময়লা আবর্জনায় বন্ধ হবার উপক্রম। বটতলী এলাকায় খালের পশ্চিম প্রান্তে ১০-১৫টি টিনশেড ঘর, বড়পুল এলাকায় ৭-৮টি সেমিপাকা বাড়ি পুনরায় গড়ে উঠেছে। খালপাড়ে দুটি সেমিপাকা কক্ষ তুলেছেন জোবায়ের সাইয়ীদ নামের এক ব্যক্তি। এ ছাড়া প্রায় এক–তৃতীয়াংশ জায়গায় তুলে ফেলা হয়েছে পাউবোর সীমানাপিলার ও লাগানো গাছপালা।
খালের জায়গায় পাকা স্থাপনা করার বিষয়ে জোবায়ের সাইয়ীদ বলেন, ‘অন্যরা বাড়িঘর করেছে। জায়গাটা ফাঁকা আছে তাই আমরাও করেছি। সরকার চাইলে যেকোনো সময় ভেঙে ফেলব।’
দিনাজপুর পৌর শহরের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ বলেন, খালটি নৌকা চলাচলের মত প্রশস্ত ছিল। মানুষের অসচেতনতায় খালটি বেহাল। খালপাড়ের বাসিন্দারা নিয়মিত ময়লা ফেলছেন। শুধু তাই নয়, বাড়িঘরের নির্মাণসামগ্রীর উচ্ছিষ্ট জিনিসপত্রও খালে ফেলছেন। এটি দেখভালের দায়িত্ব পৌরসভার। কিন্তু তারা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। খালটি দখলমুক্ত করে সংস্কার করা না হলে দিনাজপুর শহর সৌন্দর্য হারাবে। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে।
২০১৯ সালে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শেষে পাউবো প্রায় ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে খালটির সংস্কারকাজ করে। পাউবোর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়জুর রহমান জানিয়েছিলেন, খালের উভয়পাড়ে সারফেস ড্রেন নির্মাণ করা হবে। এতে স্ল্যাব বসিয়ে হাঁটার পথ তৈরি করা হবে। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় সেসবের কোনটিই আলোর মুখ দেখেনি।
দিনাজপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে ঘাগড়া খালটি শহরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৯ সালে সংস্কারকাজ শুরু করেছিলাম। সারফেস ড্রেন নির্মাণ ও হাঁটাপথ তৈরি করতে ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব করা আছে।’