৪ আগস্ট, সকাল ৭টা। শারমিন আক্তার কর্মক্ষেত্র পোশাক কারখানার উদ্দেশে বের হন। বাসায় দুই বছরের ছেলেটি ছিল তার বাবা শাহাবুল ইসলামের কাছে। কিছুক্ষণ পর শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে এক স্বজনের কাছে রেখে শাহাবুল জানান, এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবেন। তবে শাহাবুল আর জীবন্ত ফিরে আসতে পারেননি। ঢাকার সাভার উপজেলার বাইপাইল গোলচত্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গুলিতে নিহত হন তিনি।
ওই দিনই বিভিন্ন মাধ্যমে শাহাবুলের স্বজনেরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। তবে মরদেহ খুঁজতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন তাঁরা। ঘটনার সাত দিন পর ১১ আগস্ট রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেলে শাহাবুল ইসলামের নিথর দেহ। পরদিন তাঁকে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়।
শাহাবুল ইসলামের (শাওন) গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার টেপ্রীগঞ্জ ইউনিয়নের মেলাপাড়া এলাকায়। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে শাহাবুল সাভারের আশুলিয়া এলাকায় থাকতেন। সেখানে তিনি ভ্রাম্যমাণ একটি দোকানে সবজি বিক্রি করতেন।
শাহাবুলের এমন মৃত্যুর পর শিশু সন্তানকে নিয়ে এখন দিশেহারা শারমিন আক্তার। স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা, সংসারের চাপ আর শিশুটিকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ প্রতিনিয়তই তাড়া করে তাঁকে। এসব নিয়ে তাঁর রাজ্যের দুশ্চিন্তা এখন।
গত বুধবার বিকেলে দেবীগঞ্জের মেলাপাড়া এলাকায় নিহত শাহাবুল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট টিনের ঘরের বারান্দায় ছেলে মোয়াজকে নিয়ে উদাস বসে আছেন শারমিন আক্তার। তাঁর ম্লান মুখ। আধো আধো বোলে ছেলে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে, উত্তর দিচ্ছেন শারমিন।
স্বামীর ছবি দেখিয়ে শারমিন বলেন, ‘আমার ছেলেটা মাঝেমধ্যেই ছবি দেখে ওর বাবাকে ডাকে। বলে, “বাবা কবরে ঘুমাইচে, আসে না কেন?” তখন জবাব দেওয়ার কোনো ভাষা পাই না।’
শারমিন জানান বলেন, ‘৩ (আগস্ট) তারিখে সন্ধ্যায় আমি বাসায় ফিরে দেখি ওর বাবা (শাহাবুল) টাচ ফোনে (স্মার্টফোনে) মিছিলের ভিডিও দেখতাছে। পরে আমিও একটু দেখলাম। তখন সে কইল, “কালকে আমিও মিছিলে যামু।” আমি কইলাম, “তুমি কি পাগল হইছ?” পরে সে বলে, “রংপুরের আবু সাঈদ যদি তিনটা গুলি খাইতে পারে, তাইলে আমি একটা খাইতে পারব না কেন? কালকে এক ঘণ্টার জন্য হইলেও গাও-গোসুল করে পবিত্র হয়ে মিছিলে যাব।”’
একটু থেমে শারমিন আবার বলেন, ‘পরদিন ৪ (আগস্ট) তারিখ সকাল ৭টায় আমি কাজে চলে যাই। আর বেলা ১১টায় খবর পাই, আমার স্বামী গুলি খাইছে। পরে চারদিকে গন্ডগোল চলছিল, আমরা কারখানা থেকে বের হয়েও আসতে পারছিলাম না। পরে বাসায় এসে গোলাপী নামের আমার এক ভাবির কাছে শুনি, ছেলেকে ঘুমিয়ে রেখে এক ঘণ্টার কথা বলে গোসল করে বের হয়েছিল সে (শাহাবুল)।’
শাহাবুল ইসলামের মামা জুয়েল ইসলাম জানান, শাহাবুলের বুকে গুলি লেগেছিল। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে সাত দিন পর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে মেলে তাঁর মরদেহ।
আফসোস করে জুয়েল বলেন, ‘ঋণ শোধ করার জন্য ওরা স্বামী-স্ত্রী ঢাকায় কাজ করতে গেল। এখন শাহাবুল লাশ হয়ে বাড়ি এল। ওর মা–বাবাও বৃদ্ধ, গরিব মানুষ। ওর স্ত্রী ছোট্ট ছেলেটা কীভাবে মানুষ করবে, সেটা ভেবে পাচ্ছি না?’
একই রকম দুশ্চিন্তা ভর করেছে শারমিনের মাথায়ও। তিনি বলেন, ‘ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে তো ঢাকায় একা থাকা কঠিন। এখন কীভাবে চলব, কীভাবে ছেলেটাকে মানুষ করব, কোনো কূলকিনারা পাই না। বিভিন্ন সংগঠন থেকে কিছু অনুদান পেয়েছি। সেগুলো দিয়ে স্বামীর ঋণের প্রায় অর্ধেক শোধ হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে চলব কীভাবে, সেই পথ আমাদের নেই।’