ধর্মপাশায় পরিত্যক্ত জমিতে চালকুমড়া চাষ, ফলনে খুশি চাষিরা

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার হলদির হাওরে পরিত্যক্ত জমিতে চালকুমড়া চাষ। আজ শুক্রবার দুপুরে তোলাপ্রথম আলো

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাওরের পরিত্যক্ত জমিতে আগাম জাতের চালকুমড়া চাষ করা হয়েছে। উপজেলার হলদির হাওরের ২২০ কাঠা ওই পরিত্যক্ত জমিতে কুমড়া চাষ করে ১২ জন চাষি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। মৌসুম শুরুর আগেই চালকুমড়া বাজারজাত করতে পারায় দামও মিলছে বেশি।

চাষিরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আগাম চালকুমড়া চাষে তাঁদের দ্বিগুণ লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় হাওরের প্রধান ফসল ধান। এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৩১ হাজার ৫৪২ হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৫০০ হেক্টর জমি চার থেকে পাঁচ বছর আগেও পরিত্যক্ত ছিল। উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে পরিত্যক্ত জমিতে সবজি, শর্ষে ও ভুট্টার আবাদ শুরু করেন চাষিরা। ৫০০ হেক্টর পরিত্যক্ত জমির মধ্যে ৩৫০ হেক্টর জমিতে সবজি, শর্ষে ও ভুট্টা চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উপজেলার হলদির হাওরে ৮০ হেক্টর পরিত্যক্ত জমি ছিল। এর মধ্যে ৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, শর্ষে চাষের পাশাপাশি ৭ দশমিক ১২ হেক্টর (২২০ কাঠা) জমিতে প্রথমবারের মতো চালকুমড়া চাষ করা হয়েছে।

ধর্মপাশা হলদির হাওরের পরিত্যক্ত জমি থেকে চালকুমড়া তুলে বিক্রির জন্য তা খেতের পাশেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আজ শুক্রবার দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

চালকুমড়া চাষের নেপথ্যে  
ধর্মপাশায় অতীতে এর আগে বাণিজ্যিকভাবে চালকুমড়া চাষ করা হয়নি। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামের কৃষক রঙ্গু মিয়া। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে নিজেদের পাঁচ কাঠা জমিতে প্রথমবারের মতো তিনি চালকুমড়া চাষ করেন। সব মিলিয়ে ৪৫ হাজার টাকা খরচ করেন।  চালকুমড়া বিক্রি হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকার। একই ইউনিয়নের জাওয়াইল গ্রামের কৃষক আলাল মিয়া। তিনি নিজেদের ৫০ শতক জমিতে চালকুমড়া চাষ করেন। এতে খরচ হয় ৮০ হাজার টাকা। তিনি ২ লাখ ২০ হাজার টাকার চালকুমড়া বিক্রি করেন। শুরুর দিকে প্রতিটি বীজ দুই টাকা করে সংগ্রহ করেছিলেন নেত্রকোনার দুর্গাপুরের এক কৃষকের কাছ থেকে। পরে নিজেরাই বীজ সংগ্রহ শুরু করেন। চালকুমড়া চাষ লাভজনক হওয়ায় তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় এত দিন চালকুমড়া চাষ করছিলেন। কিন্তু সেখানে প্রতি কাঠা জমি আট মাসের জন্য বর্গা নিতে হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকায়। তাই কম টাকায় বর্গা নেওয়া যাবে এমন জমি খুঁজতে শুরু করেন তাঁরা।

সন্ধান পান ধর্মপাশার হওদির হাওরে থাকা পরিত্যক্ত জমির। হলদির হাওরপাড়ের ১২ জন কৃষকের কাছ থেকে আশ্বিন মাস (অক্টোবর) থেকে বৈশাখ (এপ্রিল) মাস পর্যন্ত প্রতি কাঠা পতিত জমি এক হাজার টাকা করে রঙ্গু মিয়া তাঁর সঙ্গে আরও চারজন কৃষককে যুক্ত করে ৭০ কাঠা এবং আলাল মিয়া তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচজন কৃষককে যুক্ত করে ১৫০ কাঠা জমি বর্গা নেন।

নিজেরাই করেন চারা উৎপাদন
কৃষক রঙ্গু মিয়া ও আলাল মিয়। তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় আট কাঠা জমিতে গত বছরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রায় ৭০ হাজার বীজ বপন করেন। কিছু বীজ নষ্ট হয়। সব মিলিয়ে সেখানে চারা গজায় প্রায় ৬৮ হাজার।

হলদির হাওরে পরিত্যক্ত জমিতে চালকুমড়া চাষ
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে চালকুমড়া চাষের জন্য ২২০ কাঠা পরিত্যক্ত জমি প্রস্তুত করা হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে সেখানে চারা রোপণ করা হয়। প্রতি কাঠা জমিতে ৯০টি করে গর্ত করা হয়। একেকটি গর্তে তিনটি করে চারা রোপণ করা হয়। চারাগুলো বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের খুঁটি পুঁতে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে মাচা তৈরি করা হয়। ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চালকুমড়া তুলে তা বিক্রি শুরু করা হয়। তিন থেকে চার দিন পরপর সেখান থেকে চালকুমড়া তোলা হয়। প্রথম দিকে প্রতিটি চালকুমড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি করা হয়।

সরেজমিনে আজ শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ ও প্লাস্টিকের তৈরি মাচার নিচে বাতাসে হালকা দুলছে ছোট–বড় চালকুমড়া। খেত থেকে কুমড়া তুলছেন চারজন কৃষক।

কুমড়া যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়
ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা সদর ও কলমাকান্দা উপজেলা থেকে ক্রেতারা এসে চালকুমড়া কিনে তা ঢাকা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ দেশে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করছেন। এখন চাষিরা গড়ে প্রতিটি চাল কুমড়া ২৫ টাকা পাইকারি দামে বিক্রি করছেন।

চাষি রঙ্গু মিয়া বলেন, ‘ফলন খুব ভালা অইছে। অহন পর্যন্ত আমরার প্রায় আট লাখ টাকা খরচ অইছে। এই টাকার কুমড়া বেইচ্ছালাইছি। এপ্রিল মাস পর্যন্ত আরও দুই লাখ টাকার মতন খরচ অইব। সব মিইল্যা এই জমি থাইক্যা আমরা ২২-২৫ লাখ টাকার চালকুমড়া বিক্রি করতাম হারবাম।’

চাষি আলাল মিয়া বলেন, ‘আমরার এই পর্যন্ত খরচ অইছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অহন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার বেইচ্ছালাইছি। এপ্রিল মাস পর্যন্ত আরও চাইর লাখ টাকা খরচ অইব। সব মিইল্যা আমরা ৪০ থাইক্যা ৪৫ লাখ টাকার চালকুমড়া বিক্রি করতাম হারবাম।’

হলদির হাওরের জামালপুর গ্রামের কৃষক রানা তালুকদার বলেন, ‘এই আউরও আমার ১১ কিয়ার ফরা (পতিত) জমি আছিন। এই জমিডাত কুনুদিন চাষবাষ করছি না। আমি এই জমিডা হেরারে আট মাসের লাইগ্যা কাঠাপ্রতি এক হাজার টাকা নিয়া বর্গা দিছি। এই আউরও কুমড়ার ফলন ভালো অওয়ায় আগামী বছর এই জমিডাত নিজেরাই চালকুমড়া চাষ করবাম।’

উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, উপজেলার হলদির হাওরে ৯০ ভাগ জমি জামালপুর গ্রামের ও ১০ ভাগ জমি ভাটগাঁও গ্রামের কৃষকদের। এই হাওরের পরিত্যক্ত জমিতে চালকুমড়া চাষের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই আগামী দিনে অনেক চাষিই আগাম কুমড়া চাষ করবেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাসুদ তুষার বলেন, উপজেলার হলদির হাওরে এবারই প্রথমবারের মতো ২২০ কাঠা পরিত্যক্ত জমিতে সুফলা-১ জাতের চালকুমড়া আগাম চাষ করা হয়েছে। এটি লাভজনক হওয়ায় আগামী দিনে চাষ করার জন্য কয়েকজন কৃষক ইতিমধ্যে যোগাযোগ করেছেন।