ফুলপরীর মা বললেন, বিচার পাব তো?
ফুলপরীর বাবা বলেছেন, ‘আমরা সৎ ও সত্যের পথে চলব, অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। এ জন্যই ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করছি।’
পাবনা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে আটঘরিয়া উপজেলার নিভৃত গ্রাম শিবপুর। পাকা সড়ক থেকে হাঁটাপথ। পুকুরের পাশ দিয়ে সরু পথ ধরে কিছু দূর এগোলেই একটি ফাঁকা বাড়ি। বাড়িটির চারপাশে পাটকাঠির বেড়া। ভেতরে একটি টিনের ঘর। ঘরটিও পাটকাঠির বেড়ার।
এই বাড়ি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের। গতকাল রোববার বিকেলে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা মিলল ফুলপরীর মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে। ফুলপরী তখন তাঁর বাবার সঙ্গে পাবনা শহরে ছিলেন।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ফুলপরীর মা তাসলিমা খাতুন ও বড় ভাই হযরত আলী। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তাসলিমা খাতুন বলে উঠলেন, ‘আমরা বিচার পাব তো?’
কঠিন সংগ্রাম করে সংসারের অভাব–অনটনের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বড় করছেন তাসলিমা খাতুন। পরিবারের একমাত্র উপার্জন আসে ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক আতাউর রহমানের আয়ে। নিজেরা কখনো প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় পা রাখেননি, জানিয়ে তাসলিমা বললেন, ‘আমরা কষ্ট করেছি, কিন্তু ছেলেমেয়েরা যাতে কষ্ট না করে, সে জন্য তাদের লেখাপড়া শেখানো। কত ঝড়–তুফান আসছে, কিন্তু পিছপা হইনি। তারা শিক্ষা নিয়ে চাকরি করবে, সংসারের অভাব দূর করবে।’
ফুলপরীর বড় ভাই হযরত আলী গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। এখনো চাকরি পাননি, তাই বাড়িতেই থাকেন। বড় বোন হোসনেয়ারা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পড়ছেন। থাকেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে। ছোট ভাই ওমর আলী স্থানীয় শিবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
ফুলপরী শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির কাছে তাঁর ওপর ছাত্রলীগ নেত্রীদের নির্যাতনের বর্ণনা দেন। রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তাই অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার মুখ বুজে সহ্য করবেন না। ছাত্রলীগ নেত্রীদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন প্রথম বর্ষের এই ছাত্রী।
ফুলপরী মাধ্যমিকে পড়ার সময় মেধাক্রমে সব সময় এক বা দুইয়ের মধ্যে থেকেছেন। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। হাজী দানেশ এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হওয়ায় বড় ভাইয়ের ইচ্ছায় সেখানে ভর্তি হন। কিন্তু ভর্তির মাত্র ১০ দিনের মাথায় এমন নির্মমতার শিকার হবেন, তা কারও কল্পনাতেও ছিল না।
পড়াশোনার জীবনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বড় ভাই হযরত আলী। তিনি বললেন, ভ্যানচালক বাবা ঈদে সবাইকে নতুন জামা কিনে দিতে পারেননি। তাতে কষ্ট হতো, কিন্তু ছোট ভাইবোনদের নিয়ে সততার সঙ্গে জীবন গড়বেন, এমন লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছেন।
বাড়ির সাড়ে ১৮ শতাংশ জমিই তাঁদের পরিবারের একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি। লম্বা ঘরের মধ্যে দুটি কক্ষ। একটিতে থাকেন দুই ভাই। আরেকটি বড় কক্ষে দুই পাশে দুটি চৌকি। তাতে মা–বাবা ও ফুলপরী থাকেন। মাটির ঘরে সবকিছুই অগোছালো। তবে টেবিলে বইয়ের স্তূপ।
বাড়ির উঠানে নারকেল, পেয়ারা, বরইগাছ। উঠানে বসে ফুলপরীর মা বললেন, ‘আমার মেয়ির সাথে কেন এমন করলু। মেয়ি অনেক ডরাইচে, আমার মেয়ি কখনু উনিশ কুড়ি বলে না। তাকে মাইরি ফেলতি লাগছিল।’
বিকেল পাঁচটার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে পাবনা শহরের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে মায়ের আবারও জিজ্ঞাসা, ‘ফুলপরী বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিতে পড়তে পারবে তো?’
ফেরার সময় আলাপ হলো আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে। ছেলেমেয়েদের কারণে ভ্যানচালক আতাউর এলাকার পরিচিত মুখ।
প্রতিবেশী মরিয়ম খাতুন বলেন, চার ছেলেমেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করছেন। তাঁরা পড়াশোনায় খুবই ভালো। এলাকার মানুষ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গর্ব করেন।
পাবনা শহরে ফেরার পথে দেখা হলো ফুলপরীর সঙ্গে। বাবার ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আতাউর বললেন, ফুলপরীকে তাঁর মামার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, ২০ বছর ধরে প্যাডেল ভ্যান চালিয়েছেন। কাঠ কেটেছেন। করেছেন তাঁতের কাজ। ১০ বছর আগে কিস্তির টাকা নিয়ে ব্যাটারিচালিত ভ্যান কিনেছেন। এটা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বিক্রি করেছেন বসতভিটার ৬ শতাংশ জমি।
সাহসের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ‘আমরা সৎ ও সত্যের পথে চলব, অন্যায় করলে প্রতিবাদ করব। এ জন্যই ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করছি।’
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। মেয়েকে ভ্যানে বসিয়ে বাড়ির দিকে ছোটেন আতাউর।