বাবার হোটেলে কাজ করেও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ১১৭তম বাউফলের আল আমিন

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আল আমিন হাওলাদার। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

‘ছেলেকে মানুষ করার জন্য খাবার হোটেলের ব্যবসা করেছি। রিকশা চালিয়েছি। রাতের বেলাও শ্রমিকের কাজও করেছি। আজ আর সেসব মনে নাই। কারণ, আমার ছেলে ডাক্তার হবে।’

বুকভরা গর্ব আর উচ্ছ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মো. নিজাম উদ্দিন হাওলাদার। তাঁর ছেলে মো. আল আমিন হাওলাদার এবার মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ করে নিয়েছেন। তাঁদের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে।

নিজাম উদ্দিন হাওলাদারের বসতভিটা ছাড়া কিছুই নেই। বাড়ির কাছে ছোট এক কক্ষের একটি ভাড়া ঘরে খাবার হোটেলের ব্যবসা করেন। পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিকাজও করেন। তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম একজন গৃহিণী। এই দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আল আমিন দ্বিতীয়।

আরও পড়ুন

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে আল আমিনের স্কোর ১৮৬ দশমিক ২৫। মেধাতালিকায় ১১৭তম হয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে আমার রোল নম্বর ছিল ১৮। এরপরও বৃত্তি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত ১৫ জনের বেশি ছাত্রের বৃত্তির জন্য আলাদা পাঠদান করাবেন না এবং বৃত্তির জন্য ফরম পূরণ করাবেন না। এ কারণে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। বিষয়টি আমাকে নাড়া দিয়েছিল। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে পড়াশোনা করে বড় হতে হবে। সেই স্বপ্ন পূরণে আজ এক ধাপ এগোলাম। আমার বিশ্বাস, সবার দোয়ায় ভালো কিছু করতে পারব ইনশা আল্লাহ।’

তাঁর মেডিকেলে ভর্তির খবরে স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই ফুল নিয়ে বাড়িতে এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। চলছে মিষ্টিমুখ। মাধবপুর বাজারের ব্যবসায়ী মো. নিজাম উল্লাহ বলেন, ‘এ রকম ভদ্র ও বিনয়ী স্বভাবের ভালো ছেলে বর্তমানে পাওয়া মুশকিল। ওর মধ্যে হিংসা ও অহংকারের লেশমাত্র নাই। তার এমন ভালো ফলাফলে শুধু তার বাবা ও মা নয়, গোটা এলাকার মানুষ আনন্দিত ও গর্বিত।’

ভবিষ্যতে আল আমিন পড়তে চান মেডিসিন নিয়ে। অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য কিছু করতে চান। তিনি বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা না করে পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল আমার। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন থেকেই বাবাকে সহযোগিতা করতাম, হোটেলে বাবার সঙ্গে কাজ করতাম।’ এতে তাঁর খারাপ লাগত না, ভালো লাগত।

আরও পড়ুন

পরিবারের সদস্যরা জানান, অভাবের কারণে নিজ গ্রামের মাধবপুর নিশিকান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন আল আমিন। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন। এরপর বরিশাল সরকারি কলেজে ভর্তি হন। অর্থের অভাবে অন্য সহপাঠীদের মতো মেসে উঠতে পারেননি। বরিশালে থাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় কলেজে ক্লাস করতে পারেননি। কিন্তু পড়াশোনা থেকে সরে যাননি। সব সময় চিন্তা ছিল তাঁকে বড় হতে হবে। বাবা ও মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। এ কারণে বাড়িতে বসে প্রায় এক বছর বাবার সঙ্গে নিয়মিত হোটেলে কাজ করেছেন এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস করেছেন।

আল আমিনের বাবা নিজাম উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ছোট টিনের ঘর ও ভিটা ছাড়া কিছুই নেই তাঁর। অভাবের সংসার। জীবনে কোনো দিন কোনো কিছুর জন্য বায়না করেনি আল আমিন। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা খুবই ভালো, পড়তে বলা লাগেনি। হোটেলে কাজ করেছে আবার পড়াশোনাও করেছে। রোববারও দোকানে বসে পুরি ও সমুচা বানিয়েছে, ভাত বিক্রি করেছে। আল আমিন ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ায় তিনি ও তাঁর পরিবারের সবাই গর্বিত। তিনি ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।
আল আমিনের মা নাজমা বেগম বলেন, ‘বাবায় আমার বড় ডাক্তার হউক। আমি খুবই আনন্দিত।’

মাধবপুর নিশি কান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়দেব চন্দ্র শিকারী বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু নেওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকত আল আমিন। আমার বিশ্বাস, আল আমিন অনেক বড় মাপের চিকিৎসক হবে এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে অনেক বড় অবদান রাখবে।’

আরও পড়ুন