দিনাজপুর সদর উপজেলার পাঁচবাড়ী বাজারসংলগ্ন চকরামপুর এলাকায় ফলবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহতের ঘটনায় ওভারটেকিং ও সড়কের ওপর অবৈধভাবে গাড়ির পার্কিংকে দায়ী করেছেন বাসটির যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, এসব কারণে পাঁচবাড়ী চকরামপুর ও আশপাশের সড়ক এলাকায় গত কয়েক দিনে অন্তত পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনাটির আগে ধানবোঝাই একটি ভ্যানকে ধাক্কা দিয়ে এক আরোহীকে ফেলে দেয় আমবোঝাই ট্রাকটি। সেখান থেকে বেপরোয়া গতিতে পালাতে গিয়ে নতুন করে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, আজ শুক্রবার ভোরের ঘটনাটি বাদে ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায় আগের দুর্ঘটনাগুলোয় দুজন নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে সড়কটির উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বেশ কয়েকটি ভাতের হোটেল আছে। দক্ষিণের হোটেলটির সঙ্গে প্রায় লাগোয়া অবস্থায় আছে একটি তেলের পাম্প। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত সেখানে প্রায়ই রাস্তার উভয় পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাবার খান গাড়ির চালক ও তাঁদের সহকারীরা। সেই সঙ্গে পাম্পটির আশপাশেও দাঁড়ানো থাকে নানা ধরনের যানবাহন। এতে রাস্তাটি সংকীর্ণ হয়ে এলাকাটি দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে বলে মনে করেন তাঁরা।
ঘটনাস্থলটিতে আজ ভোরে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের নাম–পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন ট্রাকচালক ও ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার মিত্রপাটি গ্রামের বাসিন্দা হাসু মিয়া (২৮); যাত্রীবাহী বাসটির সুপারভাইজার ও দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার মিলরোড এলাকার বাসিন্দা রাজেশ বাহাদুর (৩০); বাসচালকের সহকারী ও পীরগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদ আলী; যাত্রী ও চিরিরবন্দর উপজেলার কোচনা গ্রামের বাসিন্দা সায়মা মেহনাজ (৫), বোচাগঞ্জ উপজেলার বিভা আক্তার (১০) এবং ধানবোঝাই ভ্যানের আরোহী ও দিনাজপুর সদর উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের সদেশ রায় (২৩)
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নাবিল পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটির গন্তব্যস্থল ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলা। আমবোঝাই ট্রাকটি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ এলাকা থেকে চট্টগ্রামের কুমিরার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। ট্রাকটি পাঁচবাড়ী বাজার থেকে প্রায় ৫০০ গজ আগে ধানবোঝাই একটি ভ্যানকে ধাক্কা দেয়। এতে ধানের বস্তার ওপর বসে থাকা এক ব্যক্তি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। এ ঘটনায় ট্রাকচালক আরও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে দ্রুত পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চকরামপুর এলাকায় পৌঁছালে রাস্তায় বিকল আরেকটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা যাত্রীবাহী বাসটির সঙ্গে আমবোঝাই ট্রাকটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৮ জন। তাঁদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আজ বেলা ১১টার দিকে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, আহতদের কারও মাথায়, কারও হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ জড়ানো। কেউ কেউ বিছানায় বা করিডরে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। পাশেই আহাজারি করছেন হতাহতদের স্বজনেরা।
নিহত ট্রাকচালক হাসু মিয়ার স্বজন আরমান আলী বলেন, ‘গাড়িতে আম নিয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন হাসু ভাই ও তাঁর সহকারী কাওছার। ভাইকে পাশে বসিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন কাওছার। মাস পাঁচেকের ব্যবধানে হাসু ভাই তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবা ও মাকে হারিয়েছেন। এবার পাঁচ বছরের ছেলেকে রেখে নিজেই চলে গেলেন।’
যাত্রীবাহী বাসটির সি-৩ আসনে বসা ছিলেন আলমগীর হোসেন। মাথা ও পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হাসপাতালের তৃতীয় তলার করিডরে শুয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বিরামপুর পার হয়ে একটি পাম্পে নামাজের বিরতি দেন চালক। যাত্রাবিরতি দেওয়ায় কয়েকজন যাত্রীর মধ্যে বাগ্বিতণ্ডাও হয়। পাঁচবাড়ী পার হয়ে এক যাত্রী কাউগাঁও নামক এলাকায় নামার জন্য সুপারভাইজারের কাছে বসে ছিলেন। কিন্তু কাউগাঁও পৌঁছার আগেই চকরামপুর এলাকায় দেখেন রাস্তার ডানে একটি ট্রাক দাঁড়ানো। বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকটি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকটিকে ওভারটেক করার সময় নিজের লেন রেখে বাসের লেনে ঢুকে পড়ে। ট্রাকটির গতিও ছিল অনেক। মুহূর্তেই ধাক্কা লেগে বিকট শব্দ হয়। ওই সময় মাথায় আঘাত পাই। কোনোমতে জানালা দিয়ে বের হওয়ার সময় পায়েও আঘাত পেয়েছি।’
দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্যরা শঙ্কামুক্ত।
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদ হোসেন বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষে দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে সড়ক থেকে যাত্রাবাহী বাসটি পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাকটি রেকার দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। সড়কটিতে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে। দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জেনে আইনি ব্যবস্থা নিতে কাজ করা হচ্ছে।