ফুটবলে জীবন বদলের স্বপ্ন মেয়েদের
ভ্যানচালক মনোজিৎ কুমার মণ্ডলের আগে টিনের চালা ও মাটির মেঝের ছোট একটা ঘর ছিল। ঘরে আসবাব বলতে ছিল দুটি কাঠের চৌকি। দুই বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে সেই পরিস্থিতি। পুরোনো ঘরের জায়গায় তৈরি হয়েছে টিনশেডের আধাপাকা ঘর। ভাইয়ের কাছ থেকে কিনেছেন ৫ শতাংশ জমি। নতুন বাড়ি ও জমি কেনার টাকা দিয়েছেন মনোজিৎ কুমার মণ্ডলের ছোট মেয়ে ফুটবলার ইতি রানী মণ্ডল (১৮)। তাঁদের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ গ্রামে।
২০২২ সালের নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলে মাগুরার দুজন ফুটবলার ছিলেন। তাঁদের একজন হলেন ইতি রানী মণ্ডল। তিনি এখন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি বয়সভিত্তিক জাতীয় নারী ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। সম্প্রতি তাঁদের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর মা উন্নতি রানী মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চার মেয়ের তিনজনকে অল্প বয়সে বিয়ে দিছি। কিন্তু ইতিকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। সে কইছে (বলেছে) মা আমাকে চিন্তা করবা না। আমি ভার্সিটিতে পড়ব, তারপর অন্য ভাবনা। এখন এই মেয়েকে নিয়েই আমাদের যত স্বপ্ন।’
মাগুরা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ ও আশপাশের কয়েক গ্রামের অনেক পরিবারে এমন বদলের হাওয়া বইছে। আর এর সব কিছু সম্ভব হয়েছে তাঁদের মেয়েদের ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা থেকে। এই গ্রামে গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট একটি মাঠে ফুটবল অনুশীলন করে গত ছয় বছরে বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ২১ জন মেয়ে। যাঁদের অনেকেই বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। এ ছাড়া বিকেএসপিতে ভর্তি না হয়েও বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলেছেন মুন্নি নামের আরও একজন। এই মেয়েদের ঘিরে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন।
গোয়ালদহ গ্রামে গিয়ে জানা গেল ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন গত মার্চে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক অর্পিতা বিশ্বাস (১৬)। সে এখন বিকেএসপির দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় মাটির মেঝে ও টিনের চালার ছোট একটি ঘর। সেখানে থাকেন পরিবারের চার সদস্য। অর্পিতা যখন বাড়িতে আসে, তখন দুই ভাই-বোন দুই কক্ষে ঘুমায়। এ সময় অর্পিতার বাবা ও মাকে ঘুমাতে হয় বাড়ির বারান্দায় পাটি পেতে। অর্পিতার বাবা মনোরঞ্জন বিশ্বাস (৫২) প্রায় দুই দশক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁ পায়ে আঘাত পান। বর্তমানে তিনি গ্রামের বাজারে সবজি বিক্রি করেন। অর্পিতার মা গায়ত্রী বিশ্বাস এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। অভাবের কারণে পাঁচ বছর আগে তিনি এই চাকরি নেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা এমন একটি পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা অর্পিতা বিশ্বাসের এখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফুটবলার অর্পিতা প্রথম আলোকে জানায়, ‘জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত খেলতে চাই। টুয়েলভ (উচ্চমাধ্যমিক) শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা আছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীতে এখন ফুটবলার হিসেবেও চাকরির সুযোগ আছে।’
মাগুরা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ ও আশপাশের কয়েক গ্রামের অনেক পরিবারে এমন বদলের হাওয়া বইছে। আর এর সব কিছু সম্ভব হয়েছে তাঁদের মেয়েদের ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা থেকে।
সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছে অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব- ১৭ জাতীয় নারী দলে খেলা মুন্নিও (১৭)। ছুটিতে সে বাড়িতে এসেছে। পাশের রাজবাড়ী জেলার মুনসুর আলী ডিগ্রি কলেজ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির এই শিক্ষার্থীকে বেশির ভাগ সময় থাকতে হয় জাতীয় দলের ক্যাম্পে। সেখান থেকেই পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। আত্মবিশ্বাসী মুন্নি বলে, ‘শুরুতে অনেকেই আজে বাজে কথা বলত। এখন সবাই বাহবা দেয়। আমার সঙ্গে পড়ত, এমন অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ফুটবল আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আমরা যাঁরা ফুটবল খেলেছি, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বা ভালো চাকরির পাওয়ার আশা করি। কারণ, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়দের এসব জায়গায় ভালো সুযোগ রয়েছে।’
গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন বয়সী এক ডজনের বেশি মেয়ে ফুটবল নিয়ে অনুশীলন করছে। প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁদের নির্দেশনা দিচ্ছেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। প্রায় এক দশক আগে স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে মেয়েদের ফুটবল নিয়ে কাজ শুরু করেন বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি ও সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। বিদ্যালয়ের ২০ শতাংশ জায়গার ছোট মাঠে সকাল–বিকেলে এই শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে চলা নিয়মিত অনুশীলনে এসেছে সফলতা। বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষের একটি বড় আলমারি ভরে গেছে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে জয় করা ট্রফিতে। ২০২০ ও ২০২১ সালে জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিয়েছে মাগুরার মেয়েরা। এ ছাড়া বিভিন্ন টুর্নামেন্টে মাগুরাকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা রেখেছে এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
খেলাধুলার পাশাপাশি আমরা মেয়েদের পড়ালেখার প্রতি জোর দিয়ে থাকি। এ কারণে প্রতিবছরই বিকেএসপিতে আমাদের মেয়েদের ভর্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে।শহিদুল ইসলাম, ফুটবল কোচ ও সহকারী শিক্ষক
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে তাঁদের বিদ্যালয়ের ২১ জন মেয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছে। ফুটবল কোচ সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খেলাধুলার পাশাপাশি আমরা মেয়েদের পড়ালেখার প্রতি জোর দিয়ে থাকি। এ কারণে প্রতিবছরই বিকেএসপিতে আমাদের মেয়েদের ভর্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন বিকেএসপিতে ফুটবলে এককভাবে মাগুরা জেলার মেয়ের সংখ্যাই বেশি’।
মেয়েদের ফুটবল খেলার জন্য বড় মাঠের দাবি জানিয়ে আসছে এলাকার লোকজন। এ বিষয়ে মাগুরার জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে গোয়ালদহ এলাকায় মেয়েদের জন্য খাসজমিতে একটি বড় খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে স্থানীয় কিছু লোকজন ওই জমি নিয়ে মামলা করেন। আমরা মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করার উদ্যোগ নিচ্ছি।’