প্রতিযোগিতা করে সওজের সম্পত্তি দখল, কুমিল্লায় এক দিনেই ২২০টি স্থাপনা উচ্ছেদ
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নিমসার কাঁচাবাজারের বুক চিরে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। কয়েক বছর ধরে প্রতিযোগিতা করে বাজারে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অধিগ্রহণ করা জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছিল প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী। দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মহাসড়কের ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী লেনের মাঝখানের জমিও।
সব মিলিয়ে সওজের জমিতে নির্মাণ করা হয়েছিল আড়াই শতাধিক দোকানঘর। মোটা অঙ্কের টাকা অগ্রিম নিয়ে প্রতি মাসেই এসব দোকান থেকে ভাড়া তুলেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। অবশেষে এক দিনেই দখলমুক্ত হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ নিমসার কাঁচাবাজার। উচ্ছেদ করা হয়েছে সওজের সম্পত্তিতে থাকা ২২০টির বেশি অবৈধ স্থাপনা।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, কুমিল্লা সওজ, হাইওয়ে ও জেলা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ কয়েকটি দপ্তরের যৌথ অভিযানে বাজারটি পুরোপুরি দখলমুক্ত করা হয়। অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। বাজার দখলমুক্ত হওয়ায় খুশি স্থানীয় বাসিন্দারা।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলছেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বুড়িচং উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাজারে অভিযান চালিয়ে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল সওজ; কিন্তু অভিযানের এক মাসের মধ্যে আবার দখল হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর বাজার পুরোপুরি দখলমুক্ত হলেও ভবিষ্যতে যাতে আবার দখল না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যদিকে প্রশাসন ও সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজার দখল রুখতে তাঁরা বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
সরেজমিনে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেটের অন্তত ৩০ জন সদস্য দীর্ঘদিন ধরে বাজারটি দখল করে দোকানঘর নির্মাণ করেছিলেন। দখলকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন উপজেলা পরিষদের অপসারিত ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম ফারুক, পাশের পরিহলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রুহুল আমিন ভূঁইয়াসহ কয়েকজন। সরকার পতনের পর সম্প্রতি মহাসড়কের মাঝখানের জমিতে কয়েকটি দোকান নির্মাণ করেন পরিহলপাড়া গ্রামের সরওয়ারুজ্জামান।
দখলের বিষয়ে রুহুল আমিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব সম্পত্তি আমাদের বাবা-দাদাদের। ১৯৫৬ সালে সওজ এই সম্পত্তি রিকুইজিশন করেছিল, অধিগ্রহণ করেনি। তখন এগুলো চাষের জমি ছিল। যত দিন পর্যন্ত সরকারের কাজে না লাগবে, তত দিন আমরা এই সম্পত্তি ভোগদখল করব। এ জন্যই আমরা দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছি। এখন সরকারের লোকজনই এগুলো উচ্ছেদ করেছে। এ নিয়ে আমাদের কিছুই বলার নেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিমসার বাজারের অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী জানান, বাজারে প্রতিটি দোকানের জন্য ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম দেওয়া ছিল। মাসিক ভাড়া নেওয়া হতো ৩ থেকে ৩০ হাজার টাকা। মহাসড়কের দুই পাশে পুরো বাজারের ওপরে টিন দিয়ে নির্মিত যত দোকানঘর ছিল, তাঁর সবই দখল করে নির্মাণ করা। সওজের সম্পত্তিতে দোকান তুলে পুরো বাজার থেকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটটি মাসে অন্তত ২০ লাখ টাকা ভাড়া তুলতেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিনটি এক্সকাভেটর (ভেকু) মেশিন দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চলছে। অভিযানে তদারক করেন জেলা প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মো. মঈন উদ্দিন, সওজের কুমিল্লার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ভূঁঞা, ময়নামতি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার মজুমদার, বুড়িচং থানার ওসি আজিজুল হকসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা।
সহকারী কমিশনার মঈন উদ্দিন জানান, ‘বেপরোয়া দখলে মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছিল। আজ ২২০টির বেশি স্থাপনা উচ্ছেদ করে পুরো বাজার দখলমুক্ত করা হয়েছে। সেখানে থাকা তিনটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ও উচ্ছেদ করা হয়েছে। গত তিন দিন তাঁরা দখলকারীদের সরে যেতে মাইকিং করেছেন। আজ সকাল থেকে অভিযান শুরু করেন। এতে সেনাসদস্যরা সহায়তা করেন। তিনি বলেন, বাজার যাতে আবার দখল না হয়, সে জন্য সওজের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছেন। মহাসড়কের লেনের মধে৵ বেষ্টনী দিয়ে ফুলসহ বিভিন্ন গাছ লাগানো হবে। আর মহাসড়কের দুই পাশে যানবাহন থামাসহ বাজারের মালামাল ওঠানামার ব্যবস্থা করা হবে। এতে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ভূঁঞা বলেন, মানুষের মহাসড়ক পারাপারে নিমসার বাজারে পদচারী–সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। মহাসড়কের লেনের মাঝখানে শিগগিরই গাছ লাগানো হবে। এতে মহাসড়কের সৌন্দর্য বাড়বে। এ ছাড়া মহাসড়কের দুই পাশ দখলমুক্ত রাখতে নিয়মিত তদারকি করা হবে। কেউ দখলের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ময়নামতি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার মজুমদার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দখলের কারণে মহাসড়কে প্রায়ই যানজট সৃষ্টি হতো। বাজারটি দখলমুক্ত হওয়ায় যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে। মানুষ পদচারী–সেতু ব্যবহার করলে দুর্ঘটনাও কমে যাবে।