জাতীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পাওয়া অয়ন্ত বালা মাহাতোর গ্রামে আনন্দ

জাতীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পাওয়া অয়ন্ত বালা মাহাতো
ছবি: সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের নিমগাছী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ। আজ শুক্রবার সকালে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী এ মাঠে ফুটবল অনুশীলন করছিল। সবার মনে আনন্দ। অন্য দিনের চেয়ে আজ অনুশীলনে তারা একটু বেশি মনোযোগীও। কারণ, আজ অনুশীলনে এসে তারা জানতে পেরেছে, তাদের ‘নিমগাছী আদিবাসী প্রমীলা ফুটবল একাডেমি’র সদস্য অয়ন্ত বালা মাহাতো বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পেয়েছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুই ম্যাচের প্রীতি ফুটবল খেলতে যাবেন অয়ন্ত।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়েদের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে ২০১০ সালে একাডেমিটি প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় ফুটবল খেলোয়াড় চিত্তরঞ্জন মাহাতো। শুরুতে এই একাডেমির অধিকাংশ ফুটবলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর  হলেও দু-একজন বাঙালি কিশোরীও ছিল। বর্তমানে এই একাডেমিতে মেয়েদের পাশাপাশি কিছু কিশোর ফুটবলারকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর ‘ফুটবলে স্বপ্ন বুনছে তারা’ এবং ২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৩ কিশোরী ফুটবলার স্বপ্ন পূরণের পথে’ শীর্ষক প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দুই প্রতিবেদনে উঠে আসে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কিশোরী ফুটবলারদের একজন অয়ন্ত বালা মাহাতোর কথা।

অয়ন্তর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে একাডেমির প্রশিক্ষক নিহার রঞ্জন মাহাতোর সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে জানতে পারলাম, এ একাডেমির সদস্য বর্তমানে বিকেএসপিতে অধ্যয়নরত আমাদের অয়ন্ত বালা মাহাতো জাতীয় নারী দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি আমাদের জন্য অনেক বড় গৌরব আর গর্বের।’

অয়ন্ত বালা মাহাতোর বাবা মনিলাল মাহাতো ও মা শেফালি রানী মাহাতো। শুক্রবার সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার গোতিথা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

তখন সকাল নয়টা পেরিয়ে গেছে। কথা বলতে বলতেই সেখানে উপস্থিত হন নিমগাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সুলতান মাহমুদ। ‘অয়ন্ত বালা মাহাতোর বাড়ি যেতে চাই’ শুনেই তিনি পথ দেখিয়ে আমার সঙ্গে আসতে থাকলেন। সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘অয়ন্ত বালা মাহাতো জাতীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পেয়ে আমাদের গর্বিত করেছে। আমরা চাই, ভালো ফুটবল খেলে সে আরও সুনাম বয়ে নিয়ে আসুক।’

কয়েক দিন পর আজ সকালবেলাটা কুয়াশায় মোড়ানো। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার মাত্রা কমতে থাকে। পাকা রাস্তা ধরে উত্তর দিকে গোতিথা গ্রামে চলেছি আমরা। খানিকটা পথ পেরিয়ে ইট বিছানো পথে নেমে পড়ি। আরও কিছু দূর গিয়ে মাটির রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে যেতে থাকি। পথে অয়ন্ত বালা মাহাতোর বাবা মনিলাল মাহাতোর বাড়ি কোনটি জানতে চাই গ্রামের এক বাসিন্দার কাছে। তিনি একদম অয়ন্তর বাড়ির আঙিনায় আমাদের পৌঁছে দেন।

এদিককার বেশির ভাগ বাড়ি মাটির তৈরি। অয়ন্তদের বাড়িও মাটির দেয়ালে ঘেরা, ছাউনি টিনের। বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে দেখতে পেলাম, অয়ন্তর মা শেফালি রানী মাহাতো মাটি দিয়ে বাড়িঘর লেপাপোছার কাজে ব্যস্ত।

অয়ন্তর মা-বাবা দুজনই মাঠে কাজ করেন। শেফালি রানী মাহাতো বলেন, নিজের বলতে বসতবাড়িটুকু। তাই সংসার চালাতে দুজনই মাঠে কাজ করেন। তাঁর স্বামীর শরীর বর্তমানে ভালো না জানিয়ে তিনি বলেন, ৩০০-৩৫০ টাকা দিন হাজিরায় কোনোমতে চলে যাচ্ছে। তবে মেয়ের এমন সাফল্য তাঁদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে গত রাত থেকে শুনছি, মেয়ে বিদেশে খেলতে যাবে। আজ হয়তো মেয়ের সঙ্গে কথা হবে।’

ঘরে সাজিয়ে রাখা অয়ন্ত বালা মাহাতোর পুরস্কার। শুক্রবার সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার গোতিথা গ্রামে তার বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

কিছু সময় পরেই অয়ন্তর বাবা মনিলাল মাহাতো ও প্রশিক্ষক নিহার রঞ্জন মাহাতো এলেন। বাড়িতে এ সময় আশপাশের মানুষজনও এসে ভিড় জমান। সবার চোখেমুখেই আনন্দের ঝিলিক। মনিলাল মাহাতো বলেন, ‘মেয়ের ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার আগ্রহ ছিল। আমাদের ফুটবল একাডেমির শিক্ষক নিহার রঞ্জন মাহাতো সব সময় মেয়ের জন্য চেষ্টা করত। ও বিকেএসপিতে ভর্তি হলো। এখন জাতীয় দলের হয়ে বিদেশে খেলতে যাবে, সত্যি বিষয়টি আমাদের জন্য খুব আনন্দের।’ মেয়ের সফলতার জন্য সবার আশীর্বাদ কামনা করেন তিনি।

অয়ন্তরা দুই বোন আর এক ভাই। বড় বোন রিনা রানী মাহাতো স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। একমাত্র ভাই জয় কুমার মাহাতো স্থানীয় নিমগাছী ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পাশাপাশি চান্দাইকোনা বাজারে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক মজুরিতে কাজ করছেন।

অয়ন্তর ঘরে গিয়ে দেখা যায়, এ পর্যন্ত পাওয়া সব পুরস্কার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এসব তাঁর মা–বাবা আগলে রেখেছেন, কেউ এলে তাঁদের দেখতে দেন। আগে এসব খুব বেশি মূল্যবান মনে না হলেও এখন এসব তাঁদের কাছে অমূল্য বলে জানান।

অয়ন্তর এক কাকা (বাবার চাচাতো ভাই) সুশীল কুমার মাহাতো বলেন, ‘আমাদের ছোট্ট অয়ন্ত আজ জাতীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পেয়েছে। এটি আমাদের জন্য খুবই গর্বের।’ অয়ন্তর এক ঠাকুমা (বাবার বড় কাকিমা) শান্তি রানী মাহাতো বলেন, ‘অয়ন্ত বিদেশে খেলতে যাবে শুনে আমরা খুশিতে আত্মহারা। নাতনির জন্য শুভকামনা জানাই।’

অয়ন্ত বালা মাহাতো বর্তমানে জাতীয় নারী ফুটবল দলের আবাসিক ব্যবস্থাপনায় অনুশীলন করছেন। তাঁদের মুঠোফোন ব্যবহারে কড়াকড়ি থাকায় অয়ন্তর সঙ্গে তাই কথা বলা যায়নি। তাঁর মা–বাবা জানান, সুখবর জানার পরে মেয়ের সঙ্গে তাঁদের এখনো কথা হয়নি। ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কারও মুঠোফোনে আজ সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথা বলার সম্ভাবনা আছে।

রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হ‌ুমায়ূন কবির বলেন, অয়ন্ত বালা মাহাতোর এমন অর্জন সত্যি অসাধারণ। তাঁর এ কৃতিত্বে রায়গঞ্জ উপজেলাবাসী আনন্দিত। অয়ন্ত বালা মাহাতোর জন্য শুভকামনা জানান তিনি।