রংপুরের ৭০ শতাংশ আলু রাখার হিমাগার নেই
প্রায় এক একর জমিতে আলু চাষ করেছেন কাজল মিয়া। খেত থেকে বেশির ভাগ আলু উত্তোলনও করেছেন। কিন্তু হিমাগারে আলুর রাখার বুকিং দিতে পারেননি। রংপুর নগরের তালুক উপাসু গ্রামের এই কৃষকের দাবি, হিমাগারগুলোতে ক্ষুদ্র চাষিরা আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না।
কাজল মিয়া প্রথম আলোকে বললেন, জমির ইজারা ও বীজ আলুর দাম বেশি হওয়ায় আলু উৎপাদনে প্রতি কেজিতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ২০ টাকা। এখন আলুর দাম ১৩ থেকে ১৪ টাকা। এ অবস্থায় আলু বিক্রি করলে লোকসানে পড়বেন। হিমাগারেও রাখতে পারছেন না। এখন আলু নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছেন তিনি।
শুধু কাজল মিয়া নন, হিমাগারে আলু রাখা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন রংপুরের হাজারো কৃষক। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, একসময় মুন্সিগঞ্জ আলু উৎপাদনে শীর্ষ জেলা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রংপুরে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে। দেশের মোট আলুর ১৫ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে রংপুরে। চলতি বছর রংপুরে যে পরিমাণ আলুর আবাদ হয়েছে, তার ৭৮ শতাংশ আলু রাখার হিমাগার নেই।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রংপুরে ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৩১৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়, যা সারা দেশের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৫৭৬ মেট্রিক টন। এবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৩ হাজার ৯৫০ হেক্টরে। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৬৬ হাজার ২৮০ হেক্টরে। সম্ভাব্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার ৭২৪ মেট্রিক টন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, রংপুরে আলুচাষি সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ জন।
রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা শাকিল আখতার প্রথম আলোকে বলেন, একটি সরকারিসহ জেলায় ৪০টি আলুর হিমাগার আছে। এসব হিমাগারে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন আলু রাখার সুযোগ আছে। এর বাইরে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে ১২১টি অহিমায়িত আলুর মডেল ঘর করা হয়েছে। এসব অহিমায়িত ঘরে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করা যাবে। তাঁর দাবি, সব মিলিয়ে ৩০ শতাংশ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করা যাবে।
কৃষকেরা বলছেন, জেলায় উৎপাদিত দুই-তৃতীয়াংশ আলু সংরক্ষণের হিমাগার না থাকায় অধিকাংশ আলু উৎপাদন মৌসুমে কম দামে তাঁরা বিক্রি করতে বাধ্য হন। উৎপাদন মৌসুমে সরবরাহ বেশি থাকায় কৃষক ন্যায্য দাম পান না। এতে কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নগরের চওড়াহাটের সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৬ একর জমি ইজারা নিয়ে আলু চাষ করেছেন। উৎপাদিত আলুর ১ হাজার বস্তা হিমাগারে রাখতে চাইলেও রাখতে পেরেছেন ৬০০ বস্তা। বাকি আলু নিয়ে কী করবেন, চিন্তায় আছেন।
আলুচাষি সংগ্রাম কমিটির জেলার আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বলেন, আলুর উৎপাদন বেশি হলে কৃষকেরা সমস্যায় পড়েন। আবার কম উৎপাদন হলে ভোক্তাদের বাড়তি দামে কিনতে হয়। অথচ আলুর মতো নিত্যপণ্যের বিষয়ে সরকার বা কৃষি অধিদপ্তরের তেমন নজরদারি নেই।
জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ বণিক প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত উৎপাদিত কাঁচা আলু বিদেশে রপ্তানি করা গেলে কৃষকের লোকসান কমানো সম্ভব হতে পারে।
কিন্তু জেলা থেকে আলু রপ্তানির চিত্র হতাশাজনক। কৃষি বিভাগের গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে রংপুর থেকে সবচেয়ে বেশি ১৯ হাজার ৩৭১ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি হয়েছে। গত মৌসুমে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩৭৪ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের ১ শতাংশেরও কম। এবার মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত ৩৮৭ মেট্রিক টন আলু মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে রপ্তানি হয়েছে।
জেলার কৃষক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, রংপুরের লাখো আলুচাষিকে বাঁচাতে আলুর নানাবিধ ব্যবহার ও শিল্পের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলের প্রতি উপজেলায় সরকারিভাবে হিমাগার নির্মাণ, আলুকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা ও সরকারিভাবে আলু রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।