‘বাইচ্চান্তরে লইয়া বড়া ও হান্দেশ খাইমু, ইলাই আমরার ঈদ’

সুনামগঞ্জের দেখার হাওরপারে কান্দাহাটি গ্রামে সুবরা বেগমের ছোট্ট ঘর। এটিতেই আটজন মানুষ থাকেন। গতকাল রোববার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

দলা পাকানো চালের গুঁড়া চ্যাপটা করে ছোট ছোট বড়া বানানোর পর সেগুলো কড়াইয়ে দিচ্ছিলেন লাভলী বেগম (২৫)। চুলায় খড়ের আগুন কমে আসছিল বারবার। মাথা নিচু করে চুলার নিচ দিকে ফুঁ দিতে দিতে ধোঁয়ায় নাস্তানাবুদ অবস্থা। কুলায় যে পরিমাণ চালের গুঁড়া, তাতে ২০ থেকে ৩০টা বড়া হবে।

ঈদের আয়োজন বলতে কি শুধু এই কয়টি বড়া? লাভলী বলেন, ‘মাইয়ে (মা) কিছু গুড় আনছিলা। গুড়ের হান্দেশ (সন্দেশ) করছি। আর কিতা করমু। সকালে বাইচ্চান্তরে লইয়া বড়া ও হান্দেশ খাইমু। ইলাই আমরার ঈদ।’ কথা শেষের সঙ্গে সঙ্গে লাভলী বেগমের একটা দীর্ঘশ্বাস যেন হাওরের বাতাসে মিশে গেল। তাঁর পাশে তখন পাখির ছানার মতো বসা দুই সন্তান সাহানা (৫) ও আবির (৩)। তাদের চোখ কড়াইয়ে, তেলের ওপর ভাসতে থাকা বড়ার দিকে।

লাভলী বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরপারের কান্দাহাটি গ্রামে। গতকাল রোববার পড়ন্ত বিকেলে ওই গ্রামে গিয়ে কথা হয় লাভলী ও তাঁর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে। এর আগে গত বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বন্যার সময় ওই গ্রামের যাওয়ার পর প্রথম দেখা হয়েছিল। বন্যা সব শেষ করে দিয়ে গেছে তাঁদের। হাওরের ঢেউয়ে তখন ঘরটি ভেঙে পড়ে।

লাভলী তিন সন্তান নিয়ে মা সবুরা বেগমের সংসারে আছেন। বাবা নেই; নেই মানে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে চলে গেছেন বহু আগে। লাভলীরও একই অবস্থা, স্বামী আরেকটা বিয়ে করে আলাদা থাকেন। এখন সবুরার আটজনের সংসার। ছেলে জহুরুল ইসলামের (২০) স্ত্রী ও এক মেয়ে আছে। এই সংসার মূলত সবুরা বেগম ও ছেলে জহুরুল ইসলামের শ্রম-ঘামে চলে। সবুরা, জহুরুল দুজনই শ্রমিক। যখন যে কাজ পান, সেটাই করেন, কিন্তু অভাব যায় না।

ঘরের চুলায় তেলের বড়া ভাজছেন লাভলী বেগম। সুনামগঞ্জের দেখার হাওরপারের কান্দিগাঁও গ্রাম থেকে গতকাল রোববার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

জহুরুল বলছিলেন, ‘ঈদ ত খুশির, কিন্তু আমরার খুশির থাকি কষ্ট বেশি। ইচ্ছা খরলে বাচ্চাইন্তরে একটা নয়া কাপড় কিইন্যা দিতাম পারি না, ভালামন্দ খাইতাম পারি না।’
গত বছরের বন্যায় তছনছ হয়ে যাওয়া ঘরটিকে কোনোরকমে দাঁড় করিয়েছেন সবুরা বেগম। তবে আগে দোচালা ছিল, এখন হয়েছে একচালা খুপরির মতো। টিনের চালা, টিনের বেড়া। ভালো করে ঘর করার সামর্থ্য নেই। ওই ঘরেই সবাই থাকেন।

কড়াইয়ে বড়া ভাজার ফাঁকে ফাঁকে লাভলী বেগম জানান, এক কেজি গুড়, এক কেজি ময়দা আর এক লিটার সয়াবিন তেল কিনে এনেছেন সবুরা বেগম। ঘরের শিশুদের জন্য সন্দেশ, বড়া বানানোর জন্য। যাতে ঈদের দিন তাদের কিছু দেওয়া যায়।
জানা গেল, হাওরপারের এই গ্রামের বাসিন্দাদের দরিদ্রই বেশি। বর্ষায় হাওরে মাছ ধরে আর শুকনা মৌসুমে বোরো ধান লাগানো কিংবা শ্রমিকের কাজ প্রধান জীবিকা। নারীরাও নানাভাবে শ্রমিকের কাজ করেন।

ঈদের কেনাকাটার বিষয়ে জানতে চাইলে জহুরুল ইসলাম বলেন, বড়রা কিনতে পারেননি। ঘরের ছোটদের জন্য কিনেছেন। তা-ও একজনের কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার আনতে হয়েছে। গত বন্যায় ভেঙে পড়া ঘরটি আবার তুলতে ঋণ নিয়েছেন, কিস্তি দিতে হয়। ঘরের চারপাশে মাটি দিয়েছেন। হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই মা ও ছেলের। তাই ঈদে কোনোরকমে শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছেন।

হাওরের কান্দা ধরে হাঁটতে চোখে পড়ে বোরো ধানের সমারোহ। ধানের সবুজ রং লালচে হতে শুরু করেছে। বৈশাখে এই সোনার ধান গোলায় তুলবেন কৃষকেরা। মূলত হাওরের কৃষক এখন বৈশাখের অপেক্ষায়। নতুন ধানের আশায়। সবুজ ধানের ফাঁকে আলপথ ধরে মাথায় বস্তায় ঘাস কেটে নিয়ে আসছিলেন মাসুম আহমদ (১৪)। কাছাকাছি আসার পর কথা বলে জানা গেল, ঈদের নতুন পোশাক কিনেছে সে। ঈদের সারা দিন বন্ধুদের নিয়ে ঘুরবে, আনন্দ করবে। আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করে মাসুম।

হাওর থেকে ঘাস কেটে বস্তা মাথায় করে নিয়ে আসছে কিশোর মাসুম। রোববার বিকেলে সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে
ছবি: প্রথম আলো

হাওরে বহুকাল থেকে ‘চৈত্রের নিদান’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এই নিদানে কৃষকের ঘরে ঘরে খাবারের সংকট থাকে। কেউ কাউকে সহযোগিতা করার মতো অবস্থা থাকে না। যদিও এখন হাওরে সেই ‘নিদারুণ অভাব’ আগের মতো নেই। তবে একেবারে রেশ কাটেনি। তাই এই সময়টায় হাওরের কৃষক পরিবারে কিছুটা টানাপোড়েন থাকে। পুরান ধান শেষ হয়ে আসে। হাওরে থাকে কাজের সংকট। তাই এখন হাওরে একধরনের ‘অভাব’ আছে। তবু সাধ্য অনুযায়ী মানুষ চেষ্টা করেন ঈদের আনন্দে নিজেদের মেলাতে।

জহুরুল ইসলামের ঘরের পাশে আরেকটি ভাঙাচোরা ঘরে ঢুকে দেখা মেলে গৃহিণী জহুরা বিবির (৫০) সঙ্গে। তখন বসতঘরে হাওর থেকে একটি গরু নিয়ে ঢুকছিল ১০-১২ বছরের মাহমুদা। ঈদের প্রস্তুতি জানতে চাইলে মেয়ে মাহমুদাকে দেখিয়ে জহুরা বলেন, ‘ঈদ আর কিতা খরতাম। গরিব মানুষ। মেয়েটারে একটা নয়া কাপড় দিতাম পারছি না। মনটা বড় খারাপ লাগের।’ জহুরা জানালেন, ৩০ টাকার ডাল কিনে এনেছেন। এগুলো দিয়ে বড়া বানাবেন। এরপর শিলপাটায় ডাল পিষতে শুরু করেন তিনি।

বন্যায় এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুনামগঞ্জের দেখার হাওরপাড়ের কান্দাহাটি গ্রামের সবুরা বেগমের ঘরটি। ২০২৪ সালের ৮ জুলাই তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কান্দাহাটি গ্রামের বাসিন্দা আমির হোসেন (৪৬) বলছিলেন, হাওর এলাকার মানুষ বেশির ভাগই দরিদ্র। অনেক কষ্টে চলতে হয়। প্রতিবছর বন্যায় বসতঘরের ক্ষতি হয়। আবার বন্যায় ধানও তলিয়ে যায়। এ কারণে মানুষের অবস্থা ভালো না। তিনি বলেন, ‘যাদের টাকাপয়সা আছে, তাদের জন্য ঈদ আনন্দের। আর যারা দরিদ্র মানুষ, টাকাপয়সা নাই তারার ঈদ তো কষ্টের।’

গ্রামের আরেক বাসিন্দা সুলতান মিয়া (৭০) বলছিলেন, ‘সবাই ত সমান না, আমরা ধনী-গরিব মিইল্যা ঈদ করি। একটা দিন যেন সবাই খুশি থাকে এই চেষ্টা করি। দুঃখ-কষ্ট তো জীবনও থাকবোই।’

সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য ও সংস্কৃতিকর্মী দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী বলেন, হাওর এলাকার মানুষ মূলত বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। এটা চৈত্র মাস, এখন অনেকের ধানের গোলা খালি। মানুষের সংকট আছে। আবার বৈশাখে নতুন ধান উঠবে। তবু ঈদের আনন্দ সবার। যতই সংকট থাকুক, সেটা কাটিয়ে সবাইকে নিয়েই ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে হবে।