পাবনায় সাথি ফসলে পেঁয়াজচাষিদের দ্বিগুণ লাভ

মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের জন্য রোপণ করা হচ্ছে কন্দ বা বীজ পেঁয়াজ। সেই জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে রোপণ করা হয় অন্য বীজ। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বায়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

পেঁয়াজের ভান্ডার বলে পরিচিত পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় আগাম বা মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয়েছে। এই আবাদ করতে গিয়ে অনেক কৃষকই এখন পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে একই জমিতে নেপিয়ার ঘাস, পটোল, যব, বাঙ্গি, ফুলকপি, ধনেপাতাসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করছেন। এতে কৃষকের দ্বিগুণ লাভ হচ্ছে।

কয়েকজন কৃষক বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় সাঁথিয়ায়। পাঁচ থেকে সাত বছর আগে এখানে পেঁয়াজের জমিতে সাথি ফসলের আবাদ শুরু হয়। এখন প্রতিবছরই তা বাড়ছে। এই দুই ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ আগে ওঠে। আর তাতেই পুরো জমির আবাদের খরচ উঠে লাভ থাকে কৃষকের। এরপর অন্য ফসলটি তোলার পর লাভের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সাধারণত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে সাঁথিয়ায় মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয়। কিন্তু এবার অক্টোবরে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় এই আবাদ পিছিয়ে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের তথ্য, এবার সাঁথিয়ায় ১৬ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে লাগানো হবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ। এ পর্যন্ত ৫০০ হেক্টরের বেশি জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে।

কয়েকজন কৃষক বলেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের সময় জমি পরিচর্যা করে তাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বীজ হিসেবে কন্দ পেঁয়াজ রোপণ করা হয়। সেই কন্দ বা বীজ পেঁয়াজ থেকে পরিপূর্ণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হতে প্রায় আড়াই মাস সময় লাগে। জমিতে কন্দ পেঁয়াজ রোপণের সময় প্রতিটি সারির মধ্যে যে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা থাকে, তার মধ্যেই কৃষকেরা নেপিয়ার ঘাস, যব, পটোল, বাঙ্গিসহ পছন্দমতো কোনো ফসলের বীজ বুনে দেন। মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণের পর সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে তা তোলার উপযোগী হয়। তবে পেঁয়াজের বাজারদর ভালো থাকলে কৃষকেরা ৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যেই পেঁয়াজ তুলে বাজারে নিয়ে যান। জমি থেকে পেঁয়াজ তুলে নেওয়ার পর এর সঙ্গে লাগানো সাথি ফসল সেখানে বড় হতে থাকে। এভাবে একই সঙ্গে একাধিক ফসল আবাদে কোনো ফসলেরই ক্ষতি হয় না। বরং কৃষকেরা এক পরিশ্রমে একই জমি থেকে একাধিক ফসল পান।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাত-আট বছর আগে পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের লাভ থাকত খুব কম। তাই কৃষকেরা লাভ বাড়ানোর জন্য সেই সময়ে পেঁয়াজের সঙ্গে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেন। এ ধরনের আবাদে একই খরচ ও পরিশ্রমে কৃষকের দুটি ফসলের লাভ হতে থাকে। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে এই পদ্ধতির আবাদের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। এভাবে এর ব্যাপকতা ও জনপ্রিয়তা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।

সরেজমিনে সাঁথিয়ার বায়া গ্রামের ফসলের মাঠে দেখা যায়, দুই বিঘা জমিতে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও নেপিয়ার ঘাস লাগাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। একদল শ্রমিক সারি বেঁধে কন্দ পেঁয়াজ রোপণ করছিলেন, আর অন্য শ্রমিকেরা সেই সারির ফাঁকে ফাঁকে রোপণ করছিলেন নেপিয়ার ঘাসের বীজ। তিনি বলেন, আগে এই জমিতে তিনি এ সময়ে শুধু ঘাস চাষ করতেন। পরে পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে নেপিয়ার ঘাস চাষে সফলতা দেখে চার-পাঁচ বছর ধরে এই দুই ফসল একই জমিতে আবাদ শুরু করেছেন। এভাবে দুটি ফসলের কোনোটির ফলনেই কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং তিনি প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৫০ মণ পর্যন্ত পেঁয়াজও পাচ্ছেন, আবার আগের পরিমাণে ঘাসও পাচ্ছেন।

কেমন লাভ থাকবে, জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্রতি বিঘায় বীজ হিসেবে ছয় থেকে সাত মণ কন্দ পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়। এবার দাম বেশি হওয়ায় এক বিঘা জমিতে প্রায় ৬০ হাজার টাকার কন্দ বীজ লেগেছে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে অন্যান্য খরচ ১০ হাজার টাকা যোগ করা হলে মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। তিনি এবার কমপক্ষে প্রতি বিঘায় ৪৫ মণ পেঁয়াজ উৎপাদনের আশা করছেন। বর্তমান বাজারদর (গড়ে প্রতি মণ পাঁচ হাজার টাকা) অনুযায়ী এর দাম সোয়া দুই লাখ টাকা। আবার পেঁয়াজ ওঠার সময় প্রতি মণের দাম যদি তিন হাজার টাকায়ও নেমে আসে, তাতেও তাঁর উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ৬৫ হাজার টাকা লাভ হওয়ার কথা। এরপর ঘাসের লাভের হিসাব তো আলাদা রয়েছেই।

এদিকে উপজেলার অনেক জায়গাতেই দেখা যায়, জমি পরিচর্যা করে তাতে পেঁয়াজের সাথি ফসল হিসেবে মিষ্টিকুমড়া, মরিচ, যব অথবা অন্য কোনো সাথি ফসল লাগানো হচ্ছে। উপজেলার বনগ্রামের কৃষক শরিফ হোসেন বলেন, ‘গত বছর পেঁয়াজের সঙ্গে মরিচের আবাদ কইর‌্যা ভালো লাভ পাইছি। তাই এবারও পেঁয়াজের সাথি ফসল হিসেবে মরিচ আবাদ করব।’

সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, ‘পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসলের আবাদ বেশ লাভজনক একটি কৃষিপদ্ধতি। আমরা কৃষকদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি।’