এক একর জমি ইজারা নিয়ে মাছের খামার করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। ব্যাংকঋণ নিয়ে এতে বিনিয়োগ করেছিলেন প্রায় সাত লাখ টাকা। এক রাতের মধ্যে বন্যার পানি ঢুকে ভেসে গেছে সব মাছ। এখন কীভাবে ঋণ শোধ আর সংসার খরচ চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন।
মোহাম্মদ আলীর বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার বগাডুবি গ্রামে। গত সপ্তাহে হঠাৎ দেখা দেওয়া বন্যায় তাঁর মতো অনেক পরিবার ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বন্যার পানি কমায় শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
নদ-নদীর পানি কমায় ও নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় এ তিন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। তবে পানি কমলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। তুলনামূলক উঁচু এলাকা থেকে বন্যার পানি অনেকটা কমে গেলেও নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রাম এখনো প্লাবিত। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, তিন জেলায় এখনো ১৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে রয়েছেন।
পানি কমলেও দুর্ভোগে কমেনি
জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, সদর ও নকলা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। বন্যার পানি ধীরে ধীরে নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে। তবে এখনো প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দী।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বেলা তিনটায় ভোগাই নদের পানি বিপৎসীমার ২৩৩ সেন্টিমিটার, চেল্লাখালী নদীর পানি ১১০ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ৫০০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীর পাহাড়ি নদ মহারশি ও সোমেশ্বরীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে।
বন্যায় পাঁচ উপজেলার মৎস্যখামারের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে ঝিনাইগাতীর কয়েকটি গ্রামে দেখা যায়, পানির তোড়ে মাছগুলো ভেসে গেছে। অনেক খামার এখনো পানিতে তলিয়ে আছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, উজানে ঢল ও অতিবৃষ্টিতে পাঁচ উপজেলায় ৭ হাজার ৩৬৪টি মৎস্যখামার ও পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ৭০ কোটি টাকা।
গত চার দিন আকাশে রোদ থাকায় নিম্নাঞ্চলের প্লাবিত গ্রামগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। বাড়িঘরের পানি নেমে গেলেও আশপাশে জমে থাকা পানিতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। নৌকা ও কলাগাছের ভেলা ছাড়া চলাচল করতে পারছেন না অনেকেই। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।
এখনো ৭ হাজার পরিবার পানিবন্দী
বন্যা শুরুর সপ্তম দিনে ধীরে ধীরে কমছে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার পানি। এসব উপজেলায় গত বৃহস্পতিবার রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। পাউবোর ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন যে পানি আছে, তা জলাবদ্ধতা। তা সরতে কত সময় লাগবে, তা বলা সম্ভব নয়।
ফুলপুরে ছনধরা, সিংহেশ্বর, ফুলপুর সদর, বালিয়া ও রূপসী ইউনিয়নে ধীরে ধীরে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে পাঁচটি ইউনিয়নের ৩২টি গ্রামের প্রায় সাত হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দী। খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বন্যাকবলিত এসব এলাকায়। ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম আরিফুল ইসলাম বলেন, বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। তবে বন্যার পানি কমছে খুব ধীরে।
হালুয়াঘাটেও বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। তবে এখনো উপজেলার ২৫টি গ্রামে ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দী। ধোবাউড়ার পোড়াকান্দুলিয়া, গোয়াতলা ও ধোবাউড়া সদরে ধীরে ধীরে পানি কমছে। এর আগে সাতটি ইউনিয়নের অন্যান্য ইউনিয়নেও পানি কমতে শুরু করে। উপজেলাটিতে এখনো সাড়ে চার হাজার পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। এসব গ্রামে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে৷ ইউএনও নিশাত শারমিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পানি খুব ধীরে ধীরে কমছে।
বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি
নেত্রকোনার পাঁচটি উপজেলার অনন্ত ২৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল থেকে চার দিন ধরে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। বন্যায় প্লাবিত গ্রামগুলোর অধিকাংশ সড়ক ভেঙে গেছে। পচে গেছে আমন ধান ও সবজিখেতের ফসল। ভেসে গেছে খামারের মাছ। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রচুর ঘরবাড়ি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, মঙ্গলবার থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো প্রায় দুই হাজার পরিবার পানিবন্দী।
জেলা কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অন্তত সাড়ে ২২ হাজার হেক্টর আমন ধানখেত এখনো পানিতে নিমজ্জিত। এতে প্রায় ২৯৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান।
পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া এলাকার কৃষক মফিজ উদ্দিন বলেন, ১০ একর জমিতে আমন ধান চাষ। সব খেতের ধান পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, বন্যার পানি কয়েক দিন ধরে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু ফসল আর রক্ষা হলো না। এখনো অনেক সড়কে পানি থাকায় চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে।
বন্যার পানিতে জেলার প্রায় দেড় হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবির। তিনি বলেন, এতে আনুমানিক ৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় সড়ক ডুবে বা ভেঙে প্রায় ১২২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নেত্রকোনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম।