সুন্দরবনে বাঘের থাবায় প্রাণ হারানো শিপারের পরিবারে ঘোর অন্ধকার, পাচ্ছে না ক্ষতিপূরণও
সুন্দরবনের পাশের শান্ত সবুজ গ্রাম। সেখানকার ছোট্ট একটি দোচালা টিনের ঘর। গ্রামের অন্য ঘরগুলোর মতো এই ঘরের মেঝেও মাটির। সাড়ে পাঁচ বছরের সিনথিয়া আর তার মা মোরশেদা বেগমের চোখের জলে ভিজে আছে সেই মাটি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে দিশাহারা মা-মেয়ে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন সিনথিয়ার বাবা শিপার হাওলাদার। এর চার দিন পর ১ অক্টোবর বনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতলা এলাকা থেকে শিপারের দেহের বিচ্ছিন্ন মাথার খুলি, দুটি হাড় ও পরনে থাকা প্যান্ট-গেঞ্জি উদ্ধার করেন স্থানীয় লোকজন।
সিনথিয়াদের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, এক পাশে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে মা-মেয়ে। মোরশেদা বেগম বলেন, ‘ওর বাবাই ছিল একমাত্র ভরসা। বাদায় গেছিল মাছ ধরতে, সে যে আর ফিরবে না, কহনো বুঝিনি। বনে (নদী-খালে) যে মাছ পায়, তাই বেচেই আমাগো সংসার চলত। অনেক টাহাপয়সা না থাকলেও শান্তি ছেল। মেয়েডার এখন কী হবে? আমাদের কী হবে? এই মেয়েরে (সিনথিয়া) আমি মানুষ করব কী ওরে। আমাগো জীবনটাও অন্ধকারে ঢেকে গেল।’
স্বামীকে হারিয়ে সন্তান ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার কথা জানিয়ে মোরশেদা আরও বলেন, এই ছোট ঘর ছাড়া তাঁদের আর কিছু নেই। শ্বশুরেরও এই বাড়ি ছাড়া কোনো জমিজমাও নেই। নিজের বাবাও বৃদ্ধ, তাঁকে চলতে হয় অন্যের ওপর ভরসা করে। কয়েক মাস পর মেয়েকে স্কুলে দিতে হবে। কীভাবে কী করবেন, কিছুই বুঝে আসে না।
বন আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ বা কুমিরের আক্রমণে কেউ মারা গেলে তাঁর পরিবারকে তিন লাখ টাকা এবং গুরুতর আহত হলে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম আছে। তবে শিপার হাওলাদার সেই সুবিধা পাবেন না। কারণ, তিনি বন বিভাগের অনুমতি ছাড়াই সুন্দরবনে প্রবেশ করেছিলেন।
পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেদিন ঝাঁকি জাল (খেওলা জাল) নিয়ে শিপার সুন্দরবনের তুলাতলায় গিয়েছিল মাছ ধরতে। তাঁকে বাঘে আক্রমণ করে। তবে সঙ্গে কেউ না থাকায় সে খবর আসেনি লোকালয়ে। এদিকে পরিবারের লোকজন ভেবেছিলেন হয়তো কোনো কারণে দেরি হচ্ছে। সুন্দরবনে এমন এক বেলা, আধা বেলা দেরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এরপর রাত পার হলো, দিন পার হলো কিন্তু শিপারের আর কোনো খোঁজ নেই। চার দিন পর গ্রামবাসী তাঁর খোঁজে বন গিয়ে মিলে বাঘে খাওয়া শিপারেরে দেহাবশেষ। বনের কাছের অনেকেই এভাবে এক বেলার জন্য মাছ ধরতে যান বিভিন্ন সময়। কিন্তু এমন ঘটনা সচরাচর শোনা যায় না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. কামাল হোসেন তালুকদার বলেন, শিপার পাস নিয়েই সুন্দরবনে যেতেন। অভাবী মানুষ, সেদিন হয়তো বাড়ির পাশের বনে, তাই পাস না নিয়েই চলে গিয়েছিলেন। তাঁর ছোট্ট একটা মেয়ে। মানবিক দৃষ্টিতে হলেও পরিবারটিকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। শিপারের স্ত্রী ও সন্তানের বেঁচে থাকার মতো কোনো অবলম্বন নেই। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সুন্দরবন বন বিভাগ, উপজেলা পরিষদ, মৎস্য বিভাগ, জেলা প্রশাসনসহ সবার কাছে শিপারের পরিবারকে সহযোগিতার আবেদন জানান তিনি।
শিপারের বাবা ফারুক হাওলাদার এবং ১৭ বছর বয়সী ছোট ভাই ফোরকান হাওলাদারও জেলে। তাঁরাও সুন্দরবন থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলের এমন মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তাঁরাও। ফারুক হাওলাদার বলেন, শিপার সুন্দরবনে যাওয়ার আগে তিনি সাগরে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাগর থেকে ফিরে শোনেন, চার দিন ধরে শিপার বাড়ি আসে না। ফোনও বাড়িতে রেখে গেছে। পরের দিন সুন্দরবনে অনেক খোঁজাখুঁজি করে মাথার খুলি পেয়েছেন। ফারুক হাওলাদার বলেন, ‘আমার বাবায় তো চলে গেছে, কিন্তু এখন আমার নাতির কী হবে! আপনারা যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি একটু সহযোগিতা করেন, তাহলেই হয়তো মেয়েটা বেঁচে থাকতে পারবে।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধ জেলে ফারুক হাওলাদার।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, শিপার বন বিভাগের পাস না নিয়েই সুন্দরবনে প্রবেশ করেছিলেন। যার কারণে তাঁকে কোনো সহযোগিতা করা সম্ভব হচ্ছে না। পাস নিয়ে সুন্দরবনে গেলে তাঁকে আইন অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারতেন। এ জন্য সব জেলে ও স্থানীয় লোকজনকে অনুমোদন নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করার অনুরোধ জানান তিনি।