যে মেলায় পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, নারীরাই ক্রেতা

বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় বউ মেলায় স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করছেন নারীরা। শুধু কিছু পুরুষ বিক্রেতাকে মেলায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আজ সকালে পশ্চিম মহিষাবান ত্রিমোহিনী এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

রেশমি চুড়ি, আলতা, চিরুনি, হাঁড়ি-পাতিল, খুন্তি-কড়াই, পানের বাটা, খেলনা, মিষ্টান্ন—কী নেই এখানে। হরেক রকম পণ্যের পসরা মেলা চত্বরে। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের সবাই নারী। শিশুরা থাকলেও নারীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। দোকানদার ছাড়া সেখানে কোনো পুরুষ সদস্যের ঢোকার অনুমতি নেই। এভাবে নারীদের বেশি অংশগ্রহণের কারণে এর নামকরণ হয়েছে ‘বউ মেলা’।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার  ইছামতী নদীর তীরের পশ্চিম মহিষাবান ত্রিমোহিনী এলাকায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে বসছে এই ‘বউ মেলা’। দিনব্যাপী এ মেলায় ঘুরে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনে থাকেন। অন্যবারের ধারাবাহিকতায় আজ মাঘ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এ মেলা বসেছে। এর আগের দিন একই জায়গায় বসেছিল পোড়াদহ মেলা। আজ সকাল থেকেই ‘বউ মেলায়’ নারীদের ঢল নামে।

আরও পড়ুন

এ অবস্থা দেখে মেলার আয়োজক ও ত্রিমোহিনী যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক আরাফাত রহমান বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় এবারের বউ মেলায় উৎসবের আমেজ বেশি। মেলায় বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে শতাধিক দোকানি। সকাল থেকেই দোকানে দোকানে নারী ক্রেতার ভিড় আছে।’

মেলার আয়োজকেরা জানান, বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ইছামতী নদীর তীরে বসে ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহ মেলা’। ঠিক এর পরদিন বৃহস্পতিবার বসে ‘বউ মেলা’। পোড়াদহ মেলা নিয়ে নানা জনশ্রুতি আছে। ৪০০ শতাধিক বছর আগে পোড়াদহ-সংলগ্ন ইছামতী নদীতে মাঘ মাসের শেষ বুধবার অলৌকিকভাবে একটি বড় কাতলা মাছ সোনার চালুনি পিঠে নিয়ে ভেসে উঠত। ঘটনাক্রমে ওই সময় থেকে জায়গাটিকে ঘিরে মেলা বসতে শুরু করে। কালক্রমে এটি পোড়াদহের মেলা হিসেবে পরিচিতি পায়। ইছামতী, করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর বাহারি মাছ বিক্রির জন্য মেলায় নিয়ে যান জেলেরা। এসব মাছ কিনতে দূরদূরান্ত থেকে সেখানে ভিড় করেন ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। মেলা এক দিনের হলেও এর আবহ থাকে কয়েক দিন।

মেলায় বিভিন্ন বয়সী নারী ও শিশুদের ভিড় দেখা গেছে
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজন জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলা ঘিরে গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়ন ছাড়াও আশপাশের গাবতলী সদর, দুর্গাহাটা, বালিয়াদীঘি ও নশিপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে উৎসব। মেলা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন অনেক পুরুষ সদস্য। আর মেয়েরা এসেছেন বাবার বাড়িতে। পোড়াদহ মেলায় লাখো মানুষের ভিড়ের কারণে মেয়েরা মেলায় আসতে পারেন না। এ জন্য প্রায় তিন দশক ধরে জামাই মেলার এক দিন পর ত্রিমোহিনী গ্রামে নারীদের জন্য বউ মেলার আয়োজন করা হয়।

মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই নারী হলেও কিশোর ও পুরুষ বিক্রেতারা ছিলেন। সন্ধ্যার আগে যেন কোনো পুরুষ মেলায় প্রবেশ না করেন, তা আগে থেকেই বলা ছিল। আজ মেলায় নারীদের প্রসাধনী ছাড়াও রকমারি পণ্যের পসরা বসেছে। সন্দেশ, জিলাপি, নিমকি, বাতাসা, তিলের নাড়ু, খই, শুকনা মিষ্টি, কদমা, চিনি ও গুড়ের জিলাপিসহ হরেক রকমের মিষ্টান্নের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। বসেছে মাটি ও কাঠের খেলনা, বাঁশি, টমটম, রঙিন বেলুন, বাঁশি, চটপটি, ফুচকা, মৌসুমি ফল, চাটনি, আচার, কাচের চুড়ি, আলতা-ফিতা, লিপস্টিক, নেইল পলিশ, প্রসাধনীসহ নানা পণ্যের দোকান। নারী ও শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে চরকি, নাগরদোলা, ট্রেন রাইডসহ নানা আনন্দ আয়োজন।

মেলায় আসা ত্রিমোহিনী গ্রামের রোজিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছর ঘুরে মেলা উপলক্ষে বাবার বাড়ি নাইওর আসার জন্য উন্মুখ থাকি। এক দিন আগেই স্বামীর সঙ্গে বাবার বাড়িতে এসেছি। নিজের জন্য চুড়ি, ফিতা, আলতা, কানের দুল ও ঝুমকা কিনেছি। সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছি।’

মহিষাবান গ্রামের গৃহবধূ আরজেনা খাতুন বলেন, ‘পুরুষের ভিড়ে পোড়াদহ মেলায় যাওয়া যায় না। তাই এটা এই এলাকার বউ-মেয়ে-ঝিদের প্রাণের মেলা। ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় এসে পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ মেলে। আনন্দে প্রাণ ভরে যায়।’

শিশুকে পণ্য কিনে দিচ্ছেন এক মা
ছবি: প্রথম আলো

রানীরপাড়া গ্রামের গৃহবধূ স্মৃতি পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেলায় এসে আলতা, চুড়ি ও ফিতা কিনেছি। নাগরদোলায় উঠেছি, গরম জিলাপি, চটপটি-ফুচকা খেয়েছি। খুব মজা করেছি।’

মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি ও গাবতলী উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক  মশিউর রহমান সুমন বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবারের মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে নারীরা উচ্ছ্বসিত। এ মেলায় পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুরুষের প্রবেশ ঠেকাতে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।

স্বেচ্ছাসেবকেরাও কেউ মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন না। পোড়াদহ মেলার মতোই বউ মেলাকে সর্বজনীন মেলায় রূপ দিতে আয়োজকেরা নিরলসভাবে কাজ করছেন।