সাভার ও ধামরাইয়ে সংঘর্ষে নিহত ৫, আহত অর্ধশতাধিক

ঢাকার ধামরাই থানা চত্বরে থাকা গাড়িতে আগুন দেন বিক্ষোভকারীরাছবি: প্রথম আলো

ঢাকার সাভার ও ধামরাই উপজেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশের ছোড়া গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে সাংবাদিকসহ আহত অর্ধশতাধিক। নিহত হয়েছেন অন্তত দুজন।

রমজান আলীকে (৩৫) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। অপরজন শ্রাবণ গাজী (২১) পাকিজা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

রমজানকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা আবদুল আওয়াল নামের বাইপাইল মাছের আড়তের এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, রমজান বাইপাইল মাছের আড়তে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। দুপুর ১২টার দিকে আড়ত থেকে কাজ শেষে বাসায় দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। বাইপাইল এলাকায় পৌঁছালে তিনি পুলিশের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হন। তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে পাশের হাবীব ক্লিনিক ও পরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁদের শরীরে ছররা গুলি লেগেছে। আরেকজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালের সামনে আনা হলেও সেখান থেকেই তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিয়ে গেছেন বলে শুনেছি।’

এদিকে সন্ধ্যার পর আশুলিয়া ও সাভার মডেল থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় লুটপাট করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। তবে হামলার আগেই থানা থেকে সরে যান হামলাকারীরা।

এ ছাড়া আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালে রাত আটটা পর্যন্ত ২৫-৩০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিনজনকে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়েছে। তাঁদের একজনের নাম জাহিদুল ইসলাম (২৫)। অন্যদের নাম–পরিচয় জানা যায়নি।

আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৩০ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের শরীরে ছররা গুলি ও অন্যদের গুলি লেগেছে। তিনজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে।

আজ সোমবার সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত এক দফা দাবিতে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ড ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কের বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হন। পরে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ২০০-৩০০ জন আশুলিয়া থানায় হামলা চালানো হয়। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল, ছররা গুলি ছোড়েন।

আন্দোলনকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তাঁরা স্থানীয় কয়েকটি বাড়িতেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। সকাল থেকে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দায়িত্বপালনকালে মাছরাঙা টেলিভিশনের সাভার প্রতিনিধি সৈয়দ হাসিবুন নবী ছররা গুলির আঘাতে আহত হন। আন্দোলনকারীরা সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকামুখী লেনে একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন। সাভার ও আশুলিয়ায় এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মিছিলে সাভার-আশুলিয়ার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় জনতা যোগ দেন। মিছিলটি সাভার রেডিও কলোনি এলাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১০ হাজারের মতো আন্দোলনকারী যুক্ত হন। মিছিলটি সামনে এগোতে থাকলে পাকিজা এলাকায় পুলিশ অবস্থান নেন। বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল মিছিল রেখে পুলিশের সঙ্গে আলোচনা জন্য পুলিশের উদ্দেশে হেঁটে রওনা দেয়।

প্রতিনিধিদল কিছু দূর যাওয়ার পর পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। শিক্ষকেরা দুই হাত ওপরে তুলে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ না করার অনুরোধ জানান। পুলিশ অনুরোধ না শুনে চার-পাঁচটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে শিক্ষকেরা পেছনে চলে আসেন। পরে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে আন্দোলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে সাভারের বিভিন্ন এলাকা থেকে আন্দোলনকারীরা সাভার মডেল থানায় হামলা চালান। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল, ছররা গুলি নিক্ষেপ করে। সন্ধ্যা ছয়টা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আশুলিয়া ও সাভার মডেল থানায় আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল।

ধামরাইয়ে সরকারি ভবন ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
সকাল ১০টার দিকে ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ এলাকায় পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে এক নারী আহত হন। খবর ছড়িয়ে পড়ে তিনি নিহত হয়েছেন। এরপর মসজিদে মাইকিং করে এলাকাবাসী জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে শরীফবাগ বাজারে ধামরাই সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিনের দোকান ভাঙচুর করে। পরে তাঁরা উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, থানা ও প্রেসক্লাবে ভাঙচুর করেন। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সরকারি বাসভবন ও গাড়িতে, আনসার ব্যারাকে, ধামরাই পৌরসভার মেয়রের গাড়ি, দুটি ট্রাক, একটি প্রাইভেট কারে অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া উপজেলার ১ নম্বর ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।
এ ছাড়া ধামরাইয়ে থানায়ও ভাঙচুর করা হয়।


অসহায় ফায়ার সার্ভিস
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা প্রণব চৌধুরী বলেন, ‘দুপুরের দিকে আশুলিয়ায় বেক্সিমকো পিপিই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেলেও আমরা বের হতে পারিনি। আন্দোলনকারী যখন নিজেরা এসে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন, কেবল তখনই আমরা কোথাও যেতে পারছি। অন্যথায় হামলা চালানো হচ্ছে।’