চলতি বছরের ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে রায় ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমীন। এ রায় নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনার জন্ম দেয়। কেননা ওই রায়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে জয়ী ঘোষণা করেন আদালত।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩৫ বছরের ইতিহাসে রায়ের মাধ্যমে এভাবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে। আর সে নজির গড়েন বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন। শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনেও এই ধরনের ঘটনা আগে কখনো হয়নি।
আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। গত ৩ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিয়ে এখন মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন শাহাদাত হোসেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বর্তমানে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেই মেয়র আছেন। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে করা মামলায় কপাল খুলে যায় বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেনের। ‘বিশাল ব্যবধানে’ পরাজিত হওয়ার পরেও এভাবে মেয়রের দায়িত্ব পাবেন ৫ আগস্টের আগে তা ঘুণাক্ষরেও নিশ্চিত ছিলেন না কেউ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরীও। গত ১৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের সব মেয়রদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভাগীয় কমিশনারকে।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মেয়র থেকে শুরু ওয়ার্ড কাউন্সিলর—সব পদে জয়ী হন তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরী পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৬ ভোট। আর বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৪৮ হাজার ৭০৪ ভোট।
ভোটের ব্যবধান বিশাল হলেও নির্বাচনের দিন ভোট শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে কোনো ভোটই হয়নি। ওই দিন নির্বাচনে হামলা, গোলাগুলি, প্রাণহানি, বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া, কেন্দ্রের প্রবেশপথসহ আশপাশের এলাকা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ ছিল।
ওই বছরের (২০২১) ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে চট্টগ্রাম প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিনের আদালতে মামলা করেছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন। মামলায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নয়জনকে বাদী করা হয়।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন মামলা করলেও তার কার্যক্রম ছিল ধীরগতি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা আবার গতি পায়। চলতি বছরের ১ অক্টোবর সে মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। আর তাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পঞ্চম নির্বাচিত মেয়র হিসেবে জয়ী হন শাহাদাত হোসেন। আদালতের রায় ঘোষিত হলেও শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে শুরুতে অনিশ্চয়তা ছিল। কেননা রায়ের বিরুদ্ধে কেউ আপিল করে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কেউ-ই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেননি।
আদালত সূত্র জানায়, রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক মোহাম্মদ খাইরুল আমীন বলেছেন, নির্বাচনের দিনের নির্বাচনী চিত্র, ঘটনা ও অনিয়ম এবং স্থানীয়, জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব প্রকাশিত অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের পাহাড়সম অভিযোগে প্রতীয়মান হয় যে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০২১ একটি পূর্বপরিকল্পিত তামাশার, প্রহসনের এবং সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীকে মেয়র ঘোষণা দেওয়ার কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতামাত্র।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সব ভোটারের অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাদী (শাহাদাত হোসেন) বিপুল ভোটের ব্যবধানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচিত হতেন বিবাদীর (রেজাউল করিম) বিপক্ষে। বাদীর ফলাফলের পার্থক্য সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ভোটের ফলাফলে সই করেন। কিন্তু কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশে জালজালিয়াতি ও চরম অনিয়মের চিত্র স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়।
চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনকে ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। তাতে জয়ী হয়েছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি পরবর্তী দুটি নির্বাচনেও মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১০ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন বিএনপি–সমর্থিত মোহাম্মদ মনজুর আলম। ২০১৫ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ মনজুর আলমকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার গবেষক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জানা মতে আদালতের রায়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। শাহাদাত হোসেনের ঘটনাই প্রথম। দেশের অন্য সিটি করপোরেশনগুলোয়ও এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। শাহাদাত হোসেনের মামলার রায়ের পর পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রতিপক্ষের উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ ছিল। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ আপিল না করায় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দিতে ও নিতে কোনো বাধা ছিল না।