বর্ণিল পোশাকে নেচে নেচে বাবু মিয়া বিক্রি করেন ‘ঘটিগরম চানাচুর’
রংপুর নগরের বদরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে শীতের রাতে দেখা মেলে লাল–হলুদ রঙের বিশেষ কাবলি পোশাক ও মাথায় লম্বা টুপি পরিহিত এক ব্যক্তির। তাঁর শরীরে প্যাঁচানো রংবেরঙের মরিচবাতি ঝিকমিক করে জ্বলছিল। দুই পায়ে আছে ঘুঙুর। বাঁ হাতে থাকা বড় টিনের বালতির ভেতরে কয়লার গনগনে আগুন জ্বলছিল। কাঁধে দুটি ব্যাগ নিয়ে ডান হাতে ঝুনঝুনি বাজাচ্ছিলেন তিনি। একটি ব্যাগের ভেতরের স্পিকারে উচ্চ স্বরে বাজানো গান কিংবা তাঁর সাজপোশাক সহজেই নজর কাড়ছিল অন্যদের। এর মধ্যেই হাঁকডাক দিতে দিতে তিনি বলছিলেন, ‘বাবু মিয়ার ঘটিগরম, আসেন খেয়ে দেখেন, খুব মজাদার।’
এমন আয়োজন দেখে তাঁকে ঘিরে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে যাঁরা চানাচুর খেতে চাইলেন, তাঁদের গরম ঘটি থেকে লম্বা চামচের সাহায্যে চানাচুর দিলেন। দাম নেন ১০ টাকা করে। আলাপে আলাপে জানা গেল, তাঁর নাম বাবু মিয়া। বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি রংপুর মহানগরের মর্ডান মোড়ের পাশে অবস্থিত শেখপাড়া গ্রামে। ২৮ বছর ধরে তিনি রংপুর শহর ও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার হাটবাজারে ঘটিগরম চানাচুর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বাবু মিয়ার এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে চাকরি করছেন। স্ত্রী মজিরন বেগমকে নিয়ে সুখেই দিন কাটছে বলে জানালেন তিনি। ঘটিগরম চানাচুর কী, তৈরির প্রক্রিয়া ও এর বিশেষত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিনের বড় বালতির ভেতরে রয়েছে কয়লার গনগনে আগুন। সেই আগুনের ওপর বসানো থাকে কাঁসার একটি মাঝারি আকারের ঘটি। এই ঘটিতে থাকে চানাচুর। আগুনের তাপে ঘটি থাকে সব সময় গরম। এ কারণে ঘটির ভেতরে রাখা ঘি ও ডালডায় ভাজা চিকন চানাচুরও থাকে গরম। নিজের নাম অনুসারে ওই চানাচুরের নাম তিনি দিয়েছেন ‘বাবু মিয়ার ঘটিগরম চানাচুর’।
বাসের অপেক্ষায় থাকা রংপুরের ঘাঘট সেতু এলাকার শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাবু মিয়ার ঘটিগরম চানাচুর ১০ টাকা দিয়ে এই প্রথম খেলাম। মনে হচ্ছে, এই স্বাদ মুখে লেগে থাকবে। তা ছাড়া কিছুক্ষণ থেকে মনে হলো, লোক হিসেবে তিনি ভালো, নাচেনও ভালো। দেখেই মনে হয়েছে, ব্যতিক্রম পেশা বেছে নিলেও তিনি সুখী মানুষ। হাসিমুখেই চানাচুর বিক্রি করলেন তিনি।’
বাবু মিয়া বলেন, প্রতি সন্ধ্যায় নিজ হাতে তৈরি ১০ থেকে ১২ কেজি চানাচুর নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। হাটে–বাজারে, সড়কের মোড়ে, বাসস্ট্যান্ডসহ নানা এলাকায় ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করেন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায়। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টার মধ্যেই সব চানাচুর বিক্রি হয়। এতে দৈনিক তাঁর লাভ হয় গড়ে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা। এই চানাচুর বিক্রির টাকাতে সংসারের খরচ জুগিয়েছেন, দুই ছেলে–মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছেন, রংপুর নগরে ১৭ শতাংশ জমি কিনে আধা পাকা বাড়ি করেছেন। চার বিঘা আবাদি জমি বন্ধক নিয়েছেন। ব্যাংকে জমা আছে কিছু টাকা।
বাবু মিয়ার ভাষ্য, ১৩-১৪ বছর বয়সে বাবা মারা গেলে অভাবে পড়ে তাঁর পরিবার। ১৯৮৪ সালে তিনি বাড়ি ছেড়ে লালমনিরহাটের বুড়িমারী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান। সেখানে সাইফুল আলম নামের এক ভারতীয় ঘটিগরম চানাচুর বিক্রি করছিলেন। বাবুর কথা শুনে তাঁকে সঙ্গে করে শিলিগুড়িতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান সাইফুল। ২-৩ বছর সেখানে থেকে সাইফুলের কাছে বিশেষ ওই চানাচুর তৈরি ও বিক্রির কৌশল শেখেন তিনি। ভারত থেকে ফেরার সময়ে সাইফুল তাঁকে হলুদ ও লাল রংমিশ্রিত বিশেষ এক সেট কাবলি পোশাক উপহার দেন। ভারত থেকে ফিরে উপহারের পোশাক পরে তিনি ঢাকার মিরপুর, বনানী ও কচুখেতে ঘটিগরম চানাচুর বিক্রি শুরু করেন। টানা ১৭ বছর তিনি ঢাকায় ছিলেন। এরপর রংপুরে ফিরে এসে সেই চানাচুর বিক্রি করছেন।
ঢাকা, যশোর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও রংপুরের বদরগঞ্জে চারজন দরিদ্র মানুষকে এই চানাচুর তৈরি ও বিক্রির কৌশল শিখিয়েছেন বলে জানালেন বাবু মিয়া। চানাচুর বিক্রি করে সেই সব পরিবারের অভাব ঘুচেছে। তাঁরা ভালো আছে। এটা তাঁকে আনন্দ দেয়। মানুষের সঙ্গে না মিশলে তাঁর ভালো লাগে না। যত দিন বেঁচে থাকবেন, শরীর কুলাবে; তত দিন এই পেশায় থাকতে চান তিনি।