‘লাশ দেইখ্যা তো আমি বেহুঁশ, অত গুলি কি লা করল’
‘লাশ দেইখ্যা তো আমি বেহুঁশ। অত গুলি কি লা করল। ছেলেটার বুক গুলিতে ঝাঁঝরা আছিল। আমার ছেলের বুকখান চোখও লাগি রইছে। আমরা অখন কিলা চলমু, আমারে ওষুধের টেখা দিব কেটায়।’
কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন ষাটোর্ধ্ব আবুল কালাম (৬৪)। ছেলের কথা মনে হলেই তিনি নীরবে কাঁদেন। হতদরিদ্র আবুল কালাম ছেলেকে হারিয়ে এখন দিশাহারা। তাঁর আফসোস, ছেলেটা দেনার চাপে ছোট ভাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন। বলেছিলেন, ঋণ শোধ করে গ্রামে ফিরবেন। কিন্তু এভাবে লাশ হয়ে ফিরবেন, কখনো ভাবতে পারেননি আবুল কালাম।
৫ আগস্ট আবুল কালামের ছেলে সোহাগ মিয়া (২৪) ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরদিন গ্রামের বাড়িতে এনে তাঁর লাশ দাফন হয়। আবুল কালামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে। এক সময় এলাকায় রিকশা চালাতেন। এখন বয়স হওয়ায় ও রোগে-শোকে কাজ করতে পারেন না। বাড়িতেই থাকেন।
আবুল কালাম জানান, তাঁর পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে বড়, বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে সোহাগ দ্বিতীয়। চার বছর আগে সোহাগ সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেন। এরপর জমি, ঘরের গরু আর মহাজনি সুদে ঋণ নিয়ে প্রায় চার লাখ টাকা জোগাড় করে দালালকে দেন। কিন্তু সব টাকা খোয়া যায়। এরপর সুদের টাকার চাপে ছোট ভাই শুভ মিয়াকে (২০) নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালান সোহাগ মিয়া। ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ নেন দুই ভাই। থাকতেন বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায়। যা আয় করতেন মাসে মাসে সেখান থেকে কিছু টাকা পাঠাতেন বাড়িতে। সেই টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করছিলেন বাবা। হৃদ্রোগে আক্রান্ত আবুল কালামের চিকিৎসার খরচও দিতেন সোহাগ।
৫ আগস্ট সকালে বাসা থেকে বের হয়ে কারখানায় যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন দুই ভাই। ঘটনাস্থলেই সোহাগ মিয়া মারা যান। শুভ মিয়া এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরদিন সোহাগের লাশ এলাকায় নিয়ে দাফন করা হয়। শুভ মিয়ার চিকিৎসা নিয়েও চিন্তিত পরিবার।
আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা ভাঙা ঘরে থাকি। বেড়া নাই, টিন নাই। মেঘ আইলে (বৃষ্টি হলে) পানি পড়ে। একবেলা খাইলে, দুইবেলা উপাস যায়। ছেলেটা মাসে মাসে কিছু টেখা দিত। এই টেখা দিয়া চলতাম। অখন তো হে নাই, আমরারে কে দেখব?’
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, সোহাগের পরিবার খুবই দরিদ্র। যে গাড়ি লাশ নিয়ে এসেছিল, সেটার ভাড়ার টাকাও গ্রামের লোকজন দিয়েছেন। গ্রামের বাসিন্দা আইনজীবী মো. শাহিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সোহাগ মিয়া মারা যাওয়ায় দরিদ্র পরিবারটি আরও অসহায় হয়ে পড়ল। এখন আহত শুভ মিয়ার চিকিৎসা ও পরিবারটি কীভাবে চলবে, সেটাই চিন্তার বিষয়। তাদের পাশে সরকারের দাঁড়ানো উচিত।