কানের দুল বিক্রির টাকায় নাজমার খামার, মাসে আয় লাখ টাকা

নাজমা আক্তার ও তাঁর স্বামী মো. নুরুল আমিন মিলে দেখাশোনা করেন খামার। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় দুই দশক আগে নিজের ব্যবহারের সোনার দুল বিক্রি করে একটি গাভি কিনেছিলেন নাজমা আক্তার (৪০)। সেই গাভির দুধ বিক্রি করে বাড়তে থাকে তাঁর আয়। নাজমা আক্তারের খামারে এখন রয়েছে ৬০টি গাভি ও বাছুর। খামারটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে চার শ্রমিকের। শ্রমিকের মজুরিসহ সব খরচ বাদ দিয়ে খামার থেকে প্রতি মাসে তাঁর আয় হয় লাখ টাকা।

নাজমা আক্তার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একলাশপুর গ্রামের মো. নুরুল আমিনের স্ত্রী। গৃহিণী থেকে সফল খামারি হয়ে ওঠা এই নারীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় তাঁর বাড়িতে। স্বামীর পাশে বসে তুলে ধরেন তাঁর পথচলার কাহিনি। প্রসঙ্গক্রমে আসে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরোনোর কথাও।

যেভাবে শুরু

২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিয়ে হয় নাজমার। স্বামী মো. নুরুল আমিন চট্টগ্রামে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। থাকতেন চট্টগ্রাম নগরেই। সংসারের কাজকর্মের মধ্যেই দিনের বড় একটি অংশ অলস কাটত নাজমার। এরই মধ্যে অবসর সময়ে কিছু একটা করার চিন্তা করেন তিনি। স্বামীর কাছে আবদার করেন একটি গাভি কিনে দেওয়ার। গাভি কেনার জন্য নিজের কানের এক জোড়া সোনার দুলও তুলে দেন স্বামীর হাতে। ওই কানের দুল বিক্রি করা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ফ্রিজিয়ান জাতের একটি গাভি কিনে দেন তাঁর স্বামী।

নাজমা আক্তার বলেন, প্রথম কেনা গাভিটি রাখার জন্য বাড়িতে কোনো গোয়ালঘর ছিল না। রান্নাঘরের এক পাশে রাখতে হতো। গরুকে ঘাস-খড় খাওয়ানো, গোসল করানো, গরুর দুধ দোহন-বিক্রি—সব নিজেই করতেন। ওই গাভির দুধ বিক্রি করে যে আয় হতো, সেই টাকা খরচ না করে করা হতো সঞ্চয়। পরে একসময় বাছুরটি বড় হয়ে বাচ্চা দেয়। এভাবে একের পর এক গাভি-বাছুর বাড়তে থাকে।

নাজমা বলেন, গরুর সংখ্যা যখন ১০-এ পৌঁছায়, তখন খামারের জন্য বাড়ির পাশের প্রায় ৫০ শতাংশ জায়গায় নতুন ঘর নির্মাণ করেন। স্বামীকে উৎসাহিত করেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে খামারের দেখাশোনা করতে। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু হয় নতুন পথচলা। ২০ বছরে খামারের পরিধি বেড়ে বর্তমানে গরুর সংখ্যা ৬০টি। খামারের নাম দিয়েছেন নাজমা ডেইরি।

স্বামী খামার দেখাশোনা শুরু করার পর খামারের কলেবর আরও বাড়ে বলে জানান নাজমা। তিনি বলেন, বিক্রির জন্য গরু মোটাতাজা করা শুরু করেন তিনি। বাজার থেকে ছোট গরু কিনে এনে খামারে মোটাতাজা করার পর কোরবানির পশুর হাট কিংবা শবে বরাতের আগে বিক্রি করা হয়। এতে বাড়তি আয় হয় তাঁর।

নাজমার স্বামী নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের খামারে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২০০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত দুধ তিনি পাইকারি দরে বিক্রি করে দেন জেলা শহরের একাধিক নামীদামি রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি তৈরির দোকানে। ওই দুধ দিয়ে দোকানিরা নানা ধরনের মিষ্টি ও দই তৈরি করে বিক্রি করেন। ক্রেতাদের কাছে তাঁদের খামারের দুধের বিশেষ কদর রয়েছে।

তবে বর্তমানে গোখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আয়ে বেশ টান পড়েছে বলে জানান নুরুল আমিন। তিনি বলেন, আগে যে পরিমাণ আয় ছিল, বর্তমানে সব খরচ বাদ দিয়ে আয় অনেক কমে গেছে। এর পরও খামার নিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তাঁদের।

করোনা ও বন্যায় বড় ক্ষতি

নাজমা আক্তার বলেন, করোনাকালে তাঁর খামারে প্রতিদিন দুধ উৎপাদিত হতো প্রায় ৩০০ লিটার। বিধিনিষেধের কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁ তখন বন্ধ থাকায় উৎপাদিত দুধ নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। দুধ বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। কারণ, রাস্তায় পুলিশ ধাওয়া দিত। বাধ্য হয়ে শত শত মণ দুধ আশপাশের মানুষকে বিনা পয়সায় দিতে হয়েছে। পাশাপাশি দুধের উৎপাদন কমিয়ে আনার জন্য গাভিগুলোকে খাবার খাওয়ানো কমিয়ে দিতে হয়। নামমাত্র মূল্যে বেশ কিছু গরু বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

নাজমা বলেন, করোনায় খামার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সংক্রমণ কমে এলে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন তিনি। তবে সাম্প্রতিক বন্যায় নতুন করে সংকটে পড়তে হয়েছে। গরুর খামারে কোমরসমান বন্যার পানি ওঠে। বন্যায় খামারের ১৫টি গাভি ও বাছুর মারা গেছে। এসব গাভি ও বাছুরের বাজারমূল্য ছিল ২৮-৩০ লাখ টাকা। এর পরও হাল না ছেড়ে পুনরায় খামার সংস্কার করে গরু লালন-পালন করছেন।

নাজমা আক্তারের স্বামী নুরুল আমিন বলেন, ‘প্রায়ই শুনি, ডেইরি খাতের উন্নয়নে সরকার স্বল্প সুদে খামারিদের ঋণ ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে; কিন্তু করোনা ও বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমরা সরকারি কোনো ঋণসহায়তা পাইনি। বন্যায় ৩০ লাখ টাকার গরু হারিয়েছি, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে সহায়তা পেয়েছি মাত্র এক হাজার টাকা। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কিছু ঋণ নিয়েছিলাম। বন্যায় যখন মানুষ ঠিকমতো খেতে পারেননি, তখনো তাঁদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছে। অথচ পরে নতুন করে ঋণ চাওয়ার পর বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিকে ঋণ দিলে টাকা আটকে যাবে।’

মাসখানেক আগে নাজমাদের খামারের গরুর জন্য রাখা প্রায় তিন লাখ টাকা মূল্যের খড়ের গাদায় আগুন লাগে। নাজমা আক্তার বলেন, প্রতিহিংসার বশে কেউ তাঁদের খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। জেলা শহর থেকে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভানো শুরু করে। তবে আগুন নেভার আগেই সব খড় পুড়ে গেছে।

সন্তানেরাও করেন সহায়তা

নাজমা আক্তার ও নুরুল আমিন দম্পতির সংসারে তিন ছেলে। বড় ছেলে তানিম ভূঁইয়া স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়েন। মেজ ছেলে তানজিম ভূঁইয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে তামিম ভূঁইয়া পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তিন ছেলেই মা-বাবাকে খামারের কাজে সহায়তা করেন। নাজমা আক্তার বলেন, ছেলেরা বাইরে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে খামারের কাজ করে বেশি আনন্দ পায়। ছেলেদের সহযোগিতার কারণে খামার পরিচালনা তাঁদের জন্য সহজ হয়ে উঠেছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কানের দুল বিক্রি করে নাজমার খামারি হয়ে ওঠার বিষয়টি প্রেরণার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সরকারি যেসব বরাদ্দ পাওয়া গেছে, তা ক্ষুদ্র খামারিদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। তাই নাজমার মতো খামারিরা সহায়তা পাননি।