বিএনপি নেতার জেটি, হুমকিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র 

জেটি স্থানান্তরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এপিএসসিএল।

আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের সীমানাপ্রাচীরের পাশে মেঘনা নদীর তীরের জায়গা অবৈধভাবে ভরাটসহ দখল করে জেটি নির্মাণ করে ব্যবসা করছেন। এতে ধান-চালবাহী ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবিপ্রথম আলো

মেঘনা নদীর তীর অবৈধভাবে ভরাট করে জেটি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান সিরাজের বিরুদ্ধে। এতে ওই এলাকায় ভারী যানবাহন চলাচল করায় পাশের আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এপিএসসিএল) নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে নবনির্মিত জেটি স্থানান্তরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ১ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষ।

বিএনপি নেতা শাহজাহান সিরাজের দাবি, তিনি ঘাটটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন। ইজারার কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করেননি। আশুগঞ্জ থেকে ধান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ধান ওঠানোর জায়গা না থাকায় জায়গাটি সংস্কার করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর এক উপপরিচালক ১০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন। টাকা না দেওয়ায় তিনি এমন করছেন।’

তবে ভরাট করা জায়গা ইজারা দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বিআইব্লিউটিএর আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদীবন্দরের উপপরিচালক মো. মহিউদ্দিন খান। তিনি বলেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) প্রতিষ্ঠানের পাশে এ ধরনের স্থাপনা হতে পারে না। সেখানে যানবাহন নিয়ে চলাফেরা ঝুঁকিপূর্ণ। ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি বিএনপি নেতার ‘ভাঁওতাবাজি’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

বিআইডব্লিউটিএ ও বিএনপি নেতার লোকজন সূত্রে জানা গেছে, আশুগঞ্জ-ভৈরব নদী বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড চ্যানেল-১ শুল্ক আদায়’ কেন্দ্র ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ইজারা পেয়েছেন বিএনপি নেতা মো. শাহজাহান। গত ৩০ জুন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি করেন বিএনপি নেতা শাহজাহান।

চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, সব আদেশ, নির্দেশ ও শর্ত মেনে চলাসহ ইজারা দেওয়া ঘাটের সীমানায় তীরভূমির কোনোরূপ পরিবর্তন কিংবা নতুন কোনো পয়েন্ট তৈরি এবং ঘাট সীমানার মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ী কোনো অবকাঠামো তৈরির কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সেই শর্ত ভেঙে নির্ধারিত স্থানের বাইরে নদীর তীরের ৩০০–৩৫০ ফুট জমি ভরাটের মাধ্যমে নৌযান থেকে মালামাল নামানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর এসব মালামাল ট্রাকে তুলে এপিএসসিএলের পানি নির্গমনের নালার ওপর দিয়ে পরিবহন করা হচ্ছে। ওই জেটিটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাত্র ৪০০–৪৫০ ফুট দূরে নির্মাণ করা হয়েছে।

রাস্তা ও জেটি নির্মাণ করে ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে ১ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছেন এপিএসসিএলের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি স্থানীয় কিছু লোক মেঘনা নদীর বেশ কিছু অংশ ভরাট করে জেটি নির্মাণ করেছেন। জেটি থেকে এপিএসসিএলের আবাসিক এলাকার পাকা সড়ক পর্যন্ত বালুর রাস্তা রয়েছে। সড়কের নিচে এপিএসসিএলের ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের শীতল পানির (কুলিং ওয়াটার) পাইপ, কাঁচা পানির পাইপ, আগুন ও পরিষেবা (ফায়ার এবং সার্ভিস) পানির পাইপ, খাওয়ার পানির পাইপ এবং ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের (সিসিপিপি) পানি নির্গমন পথ গিয়েছে। বালুর রাস্তার ওপর দিয়ে ধান-চালের ভারী যানবাহন চলাচল করছে। এতে রাস্তার নিচে থাকা সব পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাইপলাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্ল্যান্ট দুটি দীর্ঘমেয়াদি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে লোডশেডিং বেড়ে যাবে। পাশাপাশি এপিএসসিএল মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

এপিএসসিএলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বালুর রাস্তা দিয়ে সার্বক্ষণিক ট্রাক চলাচলের কারণে প্রচুর ধুলাবালু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে এপিএসসিএলের দুটি ইউনিটের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল কমে যাবে এবং যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে প্ল্যান্ট ঘন ঘন বন্ধ করতে হবে। জেটি এলাকায় লোকজনের সমাগমের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা  হুমকিতে পড়েছে। নদীর মাঝখান পর্যন্ত ভরাট করে জেটি তৈরি করায় পানির স্রোতও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে নাব্যতা হারিয়ে পানির অভাবে প্ল্যান্ট বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে।

তিন দিনের মধ্যে মেঘনার তীরভূমিতে নৌযান ভেড়ানোসহ মালামাল ওঠানামা বন্ধ করতে ১ ডিসেম্বর শাহজাহান সিরাজকে চিঠি দেয় বিআইডব্লিউটিএ। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিআইডব্লিউটিএ ৩ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ থানা-পুলিশকে আরেকটি চিঠি দেয়। কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ওই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সম্প্রতি সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, এপিএসসিএলের সীমানাপ্রাচীরঘেঁষা কাঁচা রাস্তা দিয়ে ধান-চাল বহনকারী ট্রাক চলছে। রাস্তা থেকে উত্তর-পশ্চিম পাশের নদীর তীরভূমি পর্যন্ত প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ ফুট অংশে মাটি ফেলে জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। মালবাহী দুটি জাহাজ থেকে শ্রমিকেরা বস্তাভর্তি গম নামিয়ে ট্রাকে তুলছেন। বিএনপি নেতা শাহজাহানের পক্ষে ঘাটের সর্দার মোশারফ হোসেন ও ইনচার্জ খায়েস মিয়া বলেন, দৈনিক একটি জাহাজের মালামাল নামানো সম্ভব। গড়ে ৬০০ টন মাল নামানো হয়। দুই মাস ধরে এখানে ধান, চাল ও গম নামানো হচ্ছে। সেখানে ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই জায়গা ইজারা দেওয়া হয়নি বলে বিআইডব্লিউটিএ আমাকে জানিয়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। আর যাঁরা অবৈধভাবে নদীর তীর ভরাট করেছেন, জায়গা দখল করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’