দেশের প্রথম জাহাজ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মোগল-আরাকানি যুদ্ধের স্মৃতি

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের বন্দর গ্রামের কিল্লা পাহাড়ের দ্বিতল এই স্থাপনাটিই দেশের প্রথম জাহাজ নিয়ন্ত্রণ অফিস। আরাকানিদের পরাজিত করে মোগলেরা এই কার্যালয় স্থাপন করেপ্রথম আলো

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের বন্দর গ্রাম। এই গ্রামের পাশেই মাঝারি উচ্চতার একটি টিলা। হেঁটে ওপরে উঠতে সময় লাগে পাঁচ মিনিটের মতো। স্থানীয় লোকজনের কাছে টিলাটি কিল্লা পাহাড় নামে পরিচিত। কিল্লা পাহাড়ে উঠলেই চোখে পড়বে শতাব্দীর প্রাচীন বিধ্বস্ত একটি ভবন। দেয়াঙ কিল্লা নামে পরিচিত এ ভবনটিই দেশের প্রথম জাহাজ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। মোগল স্থাপত্যে গড়া এই ভবনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মোগল ও আরাকানিদের যুদ্ধের স্মৃতি।

ঐতিহাসিকদের মতে, আরাকানিদের পরাস্ত করে প্রথমে মোগলরা এই জাহাজ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরপর ইংরেজরা এই স্থাপনা ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ন্ত্রণ করত। এমনকি পাকিস্তান আমলেও এটি জাহাজ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ভবনের দুই ফুট চওড়া দেয়াল ইট, চুন ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা। কক্ষের সংখ্যা ১১। ভবনের ছাদ জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। কক্ষ ও সিঁড়ির প্রবেশদ্বার অনেকটা ভেঙে পড়েছে। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ভবনটির উপরিভাগ আগাছায় ছেয়ে গেছে। দ্বিতীয় তলার কক্ষের মেঝেতে পতাকার একটি স্তম্ভের কাটা অংশ দেখে বোঝা যায়, এখানে একসময় পতাকার স্তম্ভও ছিল।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৫৩৭ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত আরাকানিরা চট্টগ্রাম শাসন করত। ওই আমলে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী কিল্লা আরাকানিদের বাতিঘর ও পতাকা স্তম্ভ ছিল। বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য দুর্গও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি মোগলরা চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে আরাকানিদের সঙ্গে তীব্র নৌযুদ্ধ হয়। মোগল ও আরাকানি সৈনিকদের ভয়াবহ যুদ্ধের কেন্দ্রে ছিল আনোয়ারার বন্দর গ্রামের কিল্লা পাহাড় ও পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আরাকানি স্থাপনা। মোগল আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছিল আরাকানি অস্ত্রাগার ও জনপদ।

মোগলরা চট্টগ্রাম বিজয়ের পর বন্দরের অবস্থান বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাটে সরিয়ে নিলেও সাগরের মোহনায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে কিল্লা পাহাড়ের চূড়ায় আবার একটি পাকা ভবন নির্মাণে সাগরপথে জাহাজ চলাচলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করে। এরপর ইংরেজদের দখলে চলে যায় এই ভবন।

ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই স্থাপনা ঘিরেই হয়েছে আরাকানিদের সঙ্গে মোগলদের চট্টগ্রাম দখলের লড়াই। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের বন্দর গ্রামের কিল্লা পাহাড়ে
প্রথম আলো

দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক জামাল উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম ইংরেজ শাসনের আওতায় চলে গেলেও মোগল রাজত্বকালে প্রাচীন স্থাপত্যে নির্মিত বিশাল ভবনটি থেকে যায়। ইংরেজ আমলে ভবনটি আবার সংস্কার করে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী জাহাজ ও বহির্নোঙরে নৌযান চলাচল পর্যবেক্ষণকেন্দ্র বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। ওই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে দুরবিনের সাহায্যে গভীর সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ চিহ্নিতকরণ ও বন্দরে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করা হতো। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমল ও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেয়াঙ কিল্লা বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করেছে। বর্তমানে দেয়াঙ কিল্লার কাছে মোহনায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও কর্ণফুলী সার কারখানা। দীর্ঘদিন ধরেই ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।

ঐতিহাসিক পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থেও কিল্লা পাহাড়ের বিবরণ আছে। ওই বইয়ের কয়েকটি লাইন এমন, ‘পাহাড় চূড়ায় সারিবদ্ধ চাটি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো, গভীর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ থেকে চাটির আলো দেখা যেতো। সেই চাটি থেকেই “চাটিগ্রাম” বা “চাটিগা” ক্রমে চট্টগ্রাম নামকরণ হয়েছে।’

দেয়াঙ কিল্লা নামে পরিচিত ভবনের ভেতর রয়েছে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড। এক সময় সেখানে নিয়মিত পতাকা উঠত
প্রথম আলো

ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশের ‘ফতিয়াই ইব্রিয়া’ গ্রন্থেও দেয়াঙ পাহাড়ের এই কিল্লার উল্লেখ রয়েছে। ওই গ্রন্থে লেখা আছে, ‘কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরবর্তী কর্ণফুলীর মোহনায় আরাকানি দুর্গ, কাঠগড়, মগবাজার, মগঘাট নামে খ্যাত স্থানে আরাকানি পোতাশ্রয় ও সেনাছাউনি রয়েছে।’

বন্দর গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রাচীন বন্দরের বাসিন্দা। এটি ভাবতে গর্ব হয়। কিন্তু বর্তমানে মোগল রাজত্বকালের প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন কিল্লা পাহাড়, বাতিঘর ও পতাকা স্তম্ভ ধ্বংসের পথে। এটি সংরক্ষণ করা গেলে দেশ-বিদেশের মানুষ বহু কিছু জানতে পারত।’

বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নোয়াব আলী বলেন, কিল্লা পাহাড় সংরক্ষণ করা হলে ইতিহাস জানতে পারবেন মানুষ। পর্যটকেরা আসবেন প্রাচীন এই স্থাপনা দেখতে।