দীর্ঘ ১৯ মাস ১৪ দিন পর গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কমিটিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম না থাকায় মহানগর আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, কমিটি গঠনে পক্ষপাতা করা হয়েছে।
এদিকে পদ-পদবি পাওয়া নেতা ও তাঁদের কর্মী–সমর্থকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও সময়োপযোগী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ভবিষ্যতে মহানগর আওয়ামী লীগের যেকোনো কর্মসূচি সফল করতে পারবে।
নতুন এই কমিটিতে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আজমত উল্লা খানকে সভাপতি ও আতা উল্ল্যাহ মন্ডলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। এ ছাড়া কমিটির সহসভাপতি করা হয়েছে সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সামসুন নাহার ভূঁইয়া, মতিউর রহমান, আবদুল হাদী, রেজাউল করিম ভূঁইয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন, ওসমান আলী, আসাদুর রহমান, সফর উদ্দিন খান, শেখ মো. আসাদুল্লাহ, হেদায়েতুল ইসলাম ও মো. আবদুল আলীম মোল্লাকে।
জানতে চাইলে আবদুল হাদী বলেন, কমিটি যেটা হয়েছে, সেটি ভালো হলেও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়নি। আগে অনেককে নেতা বানানো হয়েছে, পরে তাঁরা দলের ক্ষতি করেছেন। ভবিষ্যতে দলের ক্ষতি করতে পারেন, এবারও তেমন লোকদের কমিটিতে রাখা হয়েছে। কমিটি সেই জগাখিচুড়ি হয়েছে। আওয়ামী লীগ গণসংগঠন, এখানে সব ধরনের লোকই থাকবে। সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। তবে নেতৃত্বের বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করে দল সঠিক পথে যাবে কি না।
মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফল করার জন্য রাজধানীর পাশের গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকার কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি গাজীপুরের নেতারাই উপস্থিত থাকেন।
বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সবচেয়ে বেশি নেতা–কর্মী নিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। সর্বশেষ গত বছরের শেষের দিকে বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি দেওয়ায় তাদের প্রতিরোধ করতে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই কর্মসূচিতে গাজীপুর জেলা থেকে জাহাঙ্গীর আলম বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মী নিয়ে সেখানে যোগ দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলম বিতর্কিত মন্তব্য করা, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাসহ বিভিন্ন কারণে পরপর কয়েকবার তিনি দল থেকে বহিষ্কার হন। পরে তিনি আবার দলে ফিরেও আসেন। তবে গত সংসদ নির্বাচনে তিনি গাজীপুরের তিনটি আসনে নৌকার প্রার্থীদের সমর্থন না দিয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামেন। এর মধ্যে গাজীপুর-১ আসনের নৌকার প্রার্থী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আর বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ছিলেন কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। জাহাঙ্গীর আলম অবস্থান নিয়েছিলেন রেজাউলের পক্ষে।
গাজীপুর দুই আসনের নৌকার প্রার্থী ছিলেন সাবেক ক্রীড়া ও যুব প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি কাজী আলিম উদ্দিন। জাহাঙ্গীর ছিলেন আলিমের পক্ষে। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের প্রার্থীরা সফল হতে পারেননি।
মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি শিগগিরই ঘোষণা করা হবে, এমন একটি প্রচারণা নির্বাচনের পরপরই শুরু হয়। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম নিজে থেকে কোনো ঘোষণা না দিলেও নেতা–কর্মীরা ধারণা করেছিলেন এবার বড় কোনো পদ–পদবিতে থাকছেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমিটিতেই তিনি নেই। এতে মহানগর আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা–কর্মীদের মধ্যে হাতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এই কমিটিতে মাদকসেবী, হত্যা মামলার আসামিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে। তাদের দিয়ে ভালো কিছু আশা করা সম্ভব নয়। আশা করেছিলাম, জাহাঙ্গীর আলম বড় কোনো পদ–পদবিতে থাকবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দলের রাজনীতির সঙ্গে আছি, সব সময় কমিটিতে ছিলাম কিন্তু এবার কেন রাখা হয়নি, সেটা জানা নেই।’
এর আগে ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী মাঠে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় তৎকালীন সভাপতি আজমত উল্লা খানকে পুনরায় সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. আতা উল্যাহ মন্ডলকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়েছিল।
নবগঠিত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. কাজী ইলিয়াস আহমেদ বলেন, কমিটি খুব ভালো হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। এই কমিটি কতটা সফল হবে, সেটা সময় হলেই দেখা যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে একটা পকেট কমিটি। এটি ভবিষ্যতের দলের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই কমিটিতে অনেক ত্যাগী নেতা বাদ পড়েছেন। যেখানে অনেক ত্যাগী নেতা বাদ পড়েছেন, সেখানে আমি থাকতে চাই না। আজমত উল্লা খান তাঁর নিজের ইচ্ছেমতো এবং স্বজনদের দিয়ে এই কমিটি করেছেন। এই কমিটিতে হত্যা মামলার আসামিরা পদ-পদবি পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদককে ভুল বুঝিয়ে কমিটিতে স্বাক্ষর করে নিয়ে আসা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আতা উল্যাহ মন্ডল প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করা হয়েছিল আজীবনের জন্য, আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে এসে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে ঝামেলা করেছেন। তাই তাঁকে কমিটিতে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।
আজমত উল্লা খান প্রথম আলোকে বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আর জাহাঙ্গীর আলম দল থেকে বহিষ্কৃত। তাঁকে আর দলে ফিরিয়ে আনা হয়নি। তাই তাঁকে কোনো পদে বা সদস্য হিসেবেও রাখা হয়নি।
কমিটির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কিছু ত্যাগী নেতা কমিটি থেকে বাদ পড়েছে। তবে সব মিলিয়ে কমিটি খারাপ হয়নি। একটি কমিটিতে সবাইকে তো আর জায়গা দেওয়া সম্ভব নয়। হয়তো আরেকটু বিবেচনা করা যেত।