ঈদে মাংস খেতে একটু একটু করে টাকা জমান ‘মাংস সমিতিতে’
ব্যাটারিচালিত তিন চাকার রিকশাভ্যান চালান বাবলু মিয়া (৪৮)। এই আয়ে কোনোরকমে চলে তাঁর চার সদস্যের সংসার। বছরে দুই বা তিন দিন গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ মেলে, তা–ও ঈদের সময়টায়। একবারে কিনতে গেলে আর্থিক চাপ পড়ে, এ কারণে তাঁরা গ্রামের বাসিন্দারা মিলে ‘মাংস সমিতি’ করেছেন।
প্রতি সপ্তাহে বাবলু মিয়া এই সমিতিতে ১০০ টাকা করে জমা রাখেন। জমা করা এই অর্থ দিয়ে গরু কেনেন সমিতির সবাই। এরপর গরু জবাই করে সবাই মিলে মাংস ভাগ করে নেন। গ্রামে বা পাড়ামহল্লায় এই সমিতি ‘মাংস সমিতি’ নামে পরিচিত।
বাবলু মিয়ার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দীঘি দক্ষিণপাড়া গ্রামে। এ গ্রামের ২৫ থেকে ৩০ জন মিলে এই মাংস সমিতি করেন। ঈদের আগে গরু কিনে মাংস ভাগাভাগি করে নেন।
বাবলু মিয়া বলেন, ‘আমরা দিন আনি, দিন খাই। ভ্যান চালাইয়্যা যা রোজগার হয়, তা দিয়্যা টেনেটুনে সংসার চলে। ঈদের আগে বউ-পোলাপানের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতে হয়। ঈদে আরও বাজারসদাই আছে। সব মিল্যা ঈদের আগে বেশি ট্যাহা খরচ হয়। তার ওপর মাংসের জন্য চাপ বেশি পড়ে। এ কারণে মাংস সমিতিতে নাম লিখাইছিলাম। এবার সমিতির সবাই মিল্যা গরু কিনা জবাই করছি। ভাগে সাড়ে ৭ কেজি করে মাংস পাইছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবলু মিয়ার মতো মানিকগঞ্জে বিভিন্ন এলাকার দিনমজুর, খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ বছরজুড়ে মাংস সমিতিতে চাঁদা দেন। সাপ্তাহিক অথবা মাসিক হিসেবে তাঁরা এই সমিতিতে টাকা দিয়ে থাকেন। জমা দেওয়া এই টাকা দিয়ে তাঁরা ঈদের আগে গরু কিনে মাংস ভাগাভাগি করে নেন।
সদর উপজেলার দীঘি, দীঘি দক্ষিণপাড়া, নতুন বসতি, কয়ড়া, ছুটি ভাটবাউর, ভাটবাউর, ডাউটিয়া, মুলজান ও বাগজান গ্রামে মাংস সমিতি আছে। কয়েক গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাম, পাড়া ও মহল্লায় মাংস সমিতি গঠন করা হয় থাকে। দেড় থেকে দুই যুগ ধরে চলছে এই উদ্যোগ। সাধারণত ২০ রমজান থেকে গরু কিনে মাংস ভাগাভাগি করে নেন সমিতির অনেকে। আবার কোনো কোনো সমিতির সদস্যরা ঈদের আগের দিনও গরু কিনে মাংস ভাগ করেন। এতে ঈদে পরিবারগুলোর আর্থিক চাপ কমে, পাশাপাশি বাড়তি আনন্দ করতে পারে।
সদর উপজেলার ছুটি ভাটবাউর গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, তাঁদের সমিতির সদস্যরা সারা বছর টাকা জমা রাখেন। গত রোববার সমিতির সদস্যরা সবাই মিলে গরু কিনে মাংস ভাগ নিয়েছেন। প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা দরে সাড়ে ৭ কেজি মাংস পেয়েছেন। তিনি বলেন, বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাস ৭৫০ টাকা। ঈদের আগে দাম আরও বেড়ে যায়। তবে সমিতির মাধ্যমে প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়ে ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে।
মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার মানরা গ্রামের মাংস ব্যবসায়ী আজগর আলী বলেন, অনেক এলাকার মানুষ সমিতি করে গরু কিনে মাংস ভাগ করে নিচ্ছেন। প্রতিদিন এসব সমিতির দুই থেকে তিনটি গরু কাটছেন তিনি। দিন দিন সমিতির সংখ্যাও বাড়ছে বলে তাঁর ধারণা।
কম দামে ভালো মানের মাংস পাওয়ার জন্য গ্রামে ও পাড়ামহল্লায় এই সমিতির প্রতি অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন, এমন মন্তব্য সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাসের। তিনি বলেন, সমিতি না করলে নিম্ন আয়ের মানুষের একসঙ্গে এতগুলো টাকা দিতে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়। সমিতির মাধ্যমে শুধু কম দামে মানসম্মত মাংসই নয়, এভাবে সবাই মিলে মাংস ভাগ করে নেওয়ায় ঈদের আনন্দও বাড়িয়ে তোলে। সমাজে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি হয়।