স্বর্ণালংকার ফেলে যাওয়া মালিককে খুঁজে বের করলেন অটোরিকশাচালক খায়রুল

স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহিনের ফেলে যাওয়া ব্যাগে থাকা সোনার গয়না ও নগদ টাকা। শুক্রবার মধ্যরাতে বগুড়া সদর থানায়
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

পাবনার ফরিদপুর উপজেলা সদরে স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহিন। গত ২৯ মার্চ রাতে তিনি বগুড়া নিউমার্কেট থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকায় সাড়ে ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার কেনেন। এসব স্বর্ণালংকার ও নগদ ১৫ হাজার টাকা একটি কালো ব্যাগে ভরে তিনি পাবনার ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ব্যাগটি ভুলে ফেলে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

পরে যখন দেখেন, ব্যাগটি সঙ্গে নেই, তখন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি পাননি। ঈদের আগে ব্যবসার সব পুঁজি বিনিয়োগ করে বগুড়া থেকে ওই স্বর্ণালংকার কিনেছিলেন শাহিন। ব্যাগ হারিয়ে পথে বসার জোগাড় হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সাত দিনের মাথায় তাঁর ‘ত্রাতা’ হয়ে আবির্ভূত হলেন সেই অটোরিকশাচালক। তাঁর কাছ থেকে শুক্রবার ব্যাগটি এবং তাতে থাকা স্বর্ণালংকার ও টাকা বুঝে পেয়েছেন।

সততার অনন্য নজির গড়া এই অটোরিকশাচালকের নাম খায়রুল ইসলাম। বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি। বাড়ি বগুড়া শহরের বেতগাড়ি এলাকায়। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে। সংসারের অভাব মেটাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

শুক্রবার মধ্যরাতে বগুড়া সদর থানায় স্বর্ণালংকার ও ব্যাগ ফিরিয়ে দেওয়ার এ ঘটনা ঘটে। এ সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মঈনুদ্দিন, সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ সেরাজুল ইসলাম, ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট আলমগীর হোসেন এবং স্থানীয় লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তাঁরা কলেজছাত্র খায়রুলের সততায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।

অটোরিকশাচালক ও কলেজশিক্ষার্থী খায়রুল ইসলাম
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

খায়রুল বলেন, সাত দিন আগে তাঁর অটোরিকশার যাত্রীর আসনে বসা একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী সাড়ে ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ১৫ হাজার টাকাসহ একটি ব্যাগ ফেলে যান। সেই ব্যাগ ফেরত দেওয়ার জন্য অটোরিকশা থেকে নেমে যাওয়া সেই যাত্রীকে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করেন। ব্যাগের মালিককে না পেয়ে বাড়িতে গিয়ে ঘটনাটি মাকে বলেন। প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করে ব্যাগ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেন তাঁর মা। মায়ের কথামতো এক পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তায় প্রকৃত মালিককে খুঁজে পান। এরপর পুলিশের সহায়তায় থানায় এসে মালিকের হাতে নগদ টাকা, গয়নাসহ ব্যাগ যত্নসহকারে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

খায়রুলের ভাষ্য, ‘সংসারে অভাব আছে, কিন্তু অন্যের সম্পদের প্রতি কোনো লোভ নেই। শৈশব থেকে নিজের যা আছে, সেইটুকু দিয়ে সৎভাবে জীবনযাপনের মানসিকতা নিয়ে বড় হয়েছি। কারও সম্পদ হাতিয়ে কখনো সুখী হওয়ার মতো স্বপ্ন কখনো দেখিনি। অবশেষে শুক্রবার রাতে প্রকৃত মালিকের হাতে ব্যাগ বুঝিয়ে দিতে পেরেছি। ব্যাগ পাওয়ার পর ওই ব্যবসায়ীর মুখে স্বর্গীয় হাসি দেখে বুকটা গর্বে ভরে গেছে।’

মালিকানা নিশ্চিত হওয়ার পর মোহাম্মদ শাহিনের হাতে স্বর্ণালংকার, টাকাসহ ব্যাগ হস্তান্তর করা হয়। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে বগুড়া সদর থানায়
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

এদিকে স্বর্ণালংকার, টাকাসহ হারানো ব্যাগ ফেরত পেয়ে আনন্দে পুলিশের সামনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী শাহিন। তিনি বলেন, তিনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলা সদরে জুয়েলারি ব্যবসা করেন। বাড়ি ওই উপজেলার উত্তর গোপালনগর গ্রামে। গত ২৯ মার্চ রাতে তিনি বগুড়া নিউমার্কেট থেকে সাড়ে ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার কেনার পর তিনি বাড়ি ফিরতে বাস ধরার জন্য শহরের বনানী আসছিলেন। এ জন্য শহরের সাতমাথা থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়েছিলেন। অটোরিকশা বনানী মোড়ে পৌঁছামাত্র পাবনাগামী একটি বাস পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়েন। স্বর্ণালংকার, টাকাসহ ব্যাগ ফেলে যান অটোরিকশায়। পাবনাগামী বাসটি শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর স্বর্ণালংকার, টাকাসহ ব্যাগ অটোরিকশায় ফেলে আসার কথা মনে পড়লে তাৎক্ষণিক তিনি বাস থেকে নেমে পড়েন। সেই অটোরিকশা আর খুঁজে পাননি। পরে বগুড়ার শাজাহানপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ২৫ লাখ টাকার ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন।

শাহিন আরও বলেন, ‘ঈদের আগে ব্যবসার সব পুঁজি বিনিয়োগ করে বগুড়া থেকে ওই স্বর্ণালংকার কিনেছিলাম। ওই ব্যাগ ফেরত না পেলে পথে বসতে হতো। স্বর্ণালংকারসহ হারানো ব্যাগ ফেরত পাব, সেটা কখনো কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু পৃথিবীতে এখনো খায়রুলের মতো নির্লোভ, সৎ ও মহৎ মানুষ আছেন। তাঁর অনন্য সততা ও নির্লোভ মানসিকতার কারণে অক্ষত অবস্থায় স্বর্ণালংকারসহ ব্যাগ ফেরত পেয়েছি। খায়রুলের কাছে সারা জীবনের জন্য ঋণী হয়ে রইলাম।’

বগুড়া সদর থানার ওসি এস এম মঈনুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৯ মার্চ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় স্বর্ণালংকারসহ ব্যাগ ফেলে রেখে যাওয়ার পর পাবনার জুয়েলারি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহিন রাতে থানায় এসে অটোরিকশার সন্ধান পেতে পুলিশের সহায়তা চান। তাঁকে শাজাহানপুর থানায় জিডি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অটোরিকশাচালক খায়রুল ইসলাম ট্রাফিকের কর্মকর্তা আলমগীরের কাছে এসে ব্যাগটি দেখিয়ে মালিককে খুঁজে পেতে সহায়তা চান। বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) সুমন রঞ্জন বিষয়টি জানার পর আমাকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। এ সময় কয়েক দিন আগে ব্যাগ হারিয়ে থানায় আসা জুয়েলারি ব্যবসায়ী শাহিনের কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে গয়না কেনার রসিদসহ কাগজপত্র নিয়ে থানায় আসতে বলা হয়। মালিকানা নিশ্চিত হওয়ার পর রাত ১২টার দিকে মোহাম্মদ শাহিনের হাতে স্বর্ণালংকার, টাকাসহ ব্যাগ হস্তান্তর করা হয়।’

ওসি বলেন, খায়রুলের সততায় সবাই মুগ্ধ। দারিদ্র্যের কাছে হার না–মানা এক তরুণ খায়রুল। ২৫ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার কুড়িয়ে পেয়েও তা মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে সততার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন তিনি।