প্রথমে মুঠোফোনে বিয়ে, এরপর স্বামীর কাছে নিতে তোলা হয় নৌকায়

সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের সময় নৌবাহিনী অভিযানে আটক ২১৪ যাত্রীসহ ট্রলারছবি: আইএসপিআর

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী (ক্যাম্প-৯) আশ্রয়শিবিরের ত্রিপলের ছাউনিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন রোহিঙ্গা তরুণী। ৩ এপ্রিল রাতে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী এক যুবকের সঙ্গে। এরপর তাঁর কাছে পাঠানোর জন্য তরুণীকে ৫ এপ্রিল সকালে এক দালালের হাতে তুলে দেওয়া হয়। টেকনাফের বাহারছড়ার কচ্ছপিয়ার পাহাড়ের একটি ঘরে আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে রাখা হয় তাঁকেও। গত সোমবার গভীর রাতে কচ্ছপিয়ার সমুদ্রসৈকত দিয়ে তাঁদের তুলে দেওয়া হয় একটি ট্রলারে। গত মঙ্গলবার বিকেলে ট্রলারটি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিমে গভীর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছালে ২১৪ জন যাত্রীসহ ট্রলারটি আটক করেন নৌবাহিনীর সদস্যরা।

গতকাল বুধবার সকালে ওই তরুণীসহ আটক যাত্রীদের টেকনাফ থানা-পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। দুপুরে থানা প্রাঙ্গণে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন উদ্ধার হওয়া লোকজন। ভালো চাকরি, উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিয়েসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে মানবপাচারকারী দালালেরা তাঁদের নৌকায় তুলেছিল।

স্বামীর কাছে যেতে চাওয়া ওই রোহিঙ্গা তরুণী বলেন, তাঁর পরিবার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে থাকছেন সাড়ে ৭ বছর ধরে। ত্রিপলের ছাউনিতে মা–বাবার সঙ্গে থাকেন দুই বোন, তিন ভাই। মালয়েশিয়ায় উপযুক্ত ছেলে পাওয়ায় দালালের কথায় মা–বাবা তাঁকে বিয়ে দিতে রাজি হন। মুঠোফোনে বিয়ে করা ওই ছেলের সঙ্গে তাঁর কখনো দেখা হয়নি। তবু কথিত স্বামীর পরামর্শে অন্যদের সঙ্গে তিনিও ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। ট্রলারে ওঠা পর্যন্ত তাঁর পরিবারের খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর বুঝতে পেরেছেন কাজটা ঠিক হয়নি।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মঙ্গলবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে ৪৪ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর জাহাজ ‘দুর্জয়’ অভিযান চালিয়ে এফবি কুলসুমা নামের ট্রলারটি জব্দ করে। ট্রলারে ছিল ২১৪ জন যাত্রী। এর ১১৮ জন পুরুষ, ৬৮ জন নারী ও ২৮টি শিশু রয়েছে। রাতে ট্রলারসহ আটক লোকজনকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মাছ ধরার ট্রলারে করে আটক যাত্রীদের মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে পাঠানো হচ্ছিল। ৭ এপ্রিল দিবাগত রাত দুইটার দিকে ট্রলারটি টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শাপলাপুর সৈকত দিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। ট্রলারটিতে জীবন রক্ষার ন্যূনতম সরঞ্জাম, পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি ও সুরক্ষাব্যবস্থা ছিল না।

কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সালাউদ্দিন রশীদ তানভীর জানান, মঙ্গলবার রাতে দুটি ট্রলারে করে ২১৪ জনকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটি ঘাটে আনা হয়। বুধবার সকালে তাঁদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সাগর থেকে উদ্ধার রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১২ জন বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি আরও বলেন, বাকি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়েছে।

অপহরণের পর তোলা হয় ট্রলারে

ট্রলার থেকে উদ্ধার যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন উখিয়ার কোটবাজার এলাকার এক গাড়িচালক। গাড়ি চালানোর পাশাপাশি তিনি এলাকায় মাঝেমধ্যে অটোরিকশা (টমটম) চালাতেন। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রার বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ঈদুল ফিতরের তৃতীয় দিন ২ এপ্রিল তিনি টমটম নিয়ে বের হন। কোটবাজার থেকে দুজন ব্যক্তি তাঁর টমটম ভাড়া নিয়ে মেরিন ড্রাইভের দিকে যেতে বলেন। এরপর নির্জন এলাকায় টমটম থামিয়ে তাঁকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে যাত্রীরা টেকনাফের বাহারছড়ার কচ্ছপিয়া পাহাড়ে নিয়ে যায়। সেখানকার একটি ঝুপড়ি ঘরে তাঁকে চার দিন আটকে রাখা হয়। ঘরটিতে আরও ২০-২৫ জন নারী-পুরুষ আগে থেকে আটকে ছিল। ৭ এপ্রিল রাতে তাঁকে জোর করে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়।

উদ্ধার রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ পুলিশ ফাঁড়ি উপপরিদর্শক (এসআই) হেলাল উদ্দিন বলেন, মালয়েশিয়ায় পৌঁছে রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের ভালো চাকরি ও উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। বহু মেয়েকে মুঠোফোনে বিয়ে পড়ানো হয়। অধিকাংশ নারী-পুরুষ থেকে দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে ৩০-৫০ হাজার টাকা করে। আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশুদের বের করা, সেখান থেকে গাড়িতে করে টেকনাফের কচ্ছপিয়া এলাকায় পৌঁছানো এবং ট্রলারে তুলে দেওয়া পর্যন্ত একাধিক দালাল চক্র সক্রিয় ছিল। ট্রলারটি সেন্ট মার্টিন উপকূল অতিক্রম করে মিয়ানমার জলসীমানা দিয়ে থাইল্যান্ড পৌঁছানোর কথা ছিল। সেখান থেকে হাতবদল করে যাত্রীদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।