যশোরে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে গ্রামে রাত জেগে পাহারা
যশোরে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ধর্মীয় উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি ও লুটপাট থেকে রক্ষা পেতে গত সোমবার রাত থেকে তাঁরা লাঠি, বাঁশি ও টর্চলাইট নিয়ে ধর্মীয় উপাসনালয় ও বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন।
শেখ হাসিনার পদ এ দেশত্যাগের খবরে গত সোমবার দুপুরের পর থেকে যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও বাঘারপাড়া উপজেলায় অর্ধশতাধিক হিন্দু বাড়ি এবং হিন্দুদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি ও লুটপাট করা হয়। পরের দিন মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এ সব ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় হিন্দুদের মধ্যে ভয়–আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে ধর্মীয় হামলা থেকে রক্ষা পেতে বৈঠক করে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে রাত জেগে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি, যুবক ও তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলা প্রতিহত করতে স্থানীয় লোকজন দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও বাড়ির মালিকেরা বলেন, গত সোমবার বিকেলে কয়েক শ লোক বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া বাজারের অন্তত ২৫টি দোকানে হামলা চালায়। এর মধ্যে ২০টি হিন্দুদের দোকান। তারা এ সময় দোকানে থাকা সব মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
সন্ধ্যায় বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এরপর রাতে ১০ থেকে ১২ জন রামদা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের লিটন কুন্ডুর বাড়ির ঘরের গ্রিল কেটে ঘরে ঢোকে। তাদের সবার মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল। তারা অস্ত্রের মুখে বাড়ির লোকজনদের জিম্মি করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে যান।
ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহা বলেন, বর্তমানে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট ঠেকাতে চার থেকে পাঁচজন করে দলে ভাগ হয়ে গ্রাম পাহারা দিচ্ছে।
মনিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখর রায় বলেন, ‘আমার নিজের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। একটি মন্দিরের সামনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের মধ্যে ৮টি হিন্দু অধ্যুষিত। হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট ঠেকাতে আটটি গ্রামের লোকজন রাতে ছোট ছোট দল করে গ্রামে গ্রামে পাহারা দিচ্ছেন।’
অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বারান্দী গ্রামের মনিশংকর রায়ের বাড়িতে গত সোমবার বিকেলে একদল লোক হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় একই গ্রামের বাসিন্দা ও পায়রা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিষ্ণুপদ দত্ত, রবিন বিশ্বাস, যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ও মহেন বৈরাগীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ব্যবসায়ী কৃষ্ণ দত্তের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে লুটের ঘটনা ঘটে।
সোমবার রাতে উপজেলার জয়খোলা গ্রামের রবিশংকর বিশ্বাসের বাড়িতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল ঢুকে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। এ সময় বাড়ির তিনজনকে পিটিয়ে জখম করা হয়। গ্রামের চিরঞ্জিত রায় বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত থেকে দলে দলে ভাগ হয়ে আমরা গ্রাম পাহারা দিচ্ছি।’
উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নে ১০টি গ্রাম। সব কটি গ্রাম হিন্দু অধ্যুষিত। ১০টি গ্রামের বাসিন্দা রাত জেগে গ্রামগুলো পাহারা দিচ্ছেন। সুন্দলী গ্রামের প্রিয়ব্রত ধর বলেন, রাত সাড়ে আটটা থেকে পাহারা শুরু হয় এবং ভোর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত তা চলে। সুন্দলী বাজার থেকে ১০টি গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ পর পর মোবাইলে খোঁজখবর নেওয়া হয়।
সুন্দলী ইউপির চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনে একটি অফিস ছিল। হামলা করে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমি বর্তমানে এলাকাতে থাকছি না। ইউনিয়নের সব কটি গ্রামের বাসিন্দা রাত জেগে গ্রামগুলো পাহারা দিচ্ছেন।’