সেরে উঠছে সোমেশ্বরীর ‘ক্ষত’

বালু তোলা বন্ধ থাকায় ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরছে সোমেশ্বরী নদী। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী বিজয়পুর এলাকায়।ছবি: প্রথম আলো

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীর বুকে সৃষ্ট ক্ষতচিহ্নগুলো ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। অবাধে বালু লুটপাট বন্ধ হওয়ায় নদীটি হারানো গতিপথ ফিরে পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের আশা—বালু ডাকাতি বন্ধ থাকলে গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা সোমেশ্বরী আবার ‘পাহাড়ি জনপদের ধমনি’ হয়ে উঠবে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর বুকে আগে যেখানে ড্রেজার, বাঁশের মাচায় বালু-পাথর ছাঁকনি এবং স্তূপ স্তূপ বালু রাখা ছিল, এখন সে দৃশ্য নেই। গত তিন দিনে নদীর ভবানীপুর, চৈতাটিঘাট, শ্মশানঘাট, শিবগঞ্জঘাট, বিরিশিরি, কেরনখোলা, গাওকান্দিয়াসহ বেশ কিছু স্থানে গিয়ে দেখা যায়, কোথাও অথই পানি, কোথাও বুক বা কোমরসমান পানি, আবার কোথাও হাঁটু বা এর কম পানি। কিছু স্থানে পানি না থাকলেও আগের মতো ক্ষতচিহ্ন নেই। নদীটি দেখে মনে হলো ক্ষত সেরে উঠে কিছুটা নিরাময়ের দিকে যাচ্ছে।

বালু আর পাথর ব্যবসার নামে নদীটিকে ধ্বংস করেছিল রাজনৈতিক প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে নদীটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নদীটিকে বালু আর পাথরদস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা এম এ জিন্নাহর বাড়ি নদীর পাশে নলজোরা এলাকায়। তিনি বলেন, দুই দশক ধরে বালুখেকোরা ইজারা নিয়ে শত শত ড্রেজার বসিয়ে নদীর বুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও লুটপাট করে নদীর সর্বনাশ করে ফেলছে। এখন বালু উত্তোলন না হওয়ায় মনে হচ্ছে, নদী কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে। এটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা।

স্মৃতিচারণা করে এম এ জিন্নাহ বলেন, ‘এই নদীতে স্বচ্ছ পানি ও সারা বছর প্রচুর স্রোত থাকত। বড় বড় নৌকা চলত। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই নদীর টানে বাড়িতে চলে আসতাম। তাদের নিয়ে নদীতে মহাশোলসহ প্রচুর মাছ শিকার করতাম। ২০-২৫ বছরে নদীটাকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে!’

অবৈধভাবে বালু তোলায় নষ্ট হয়ে যায় সোমেশ্বরী নদীর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। নেত্রকোনার দুর্গাপূর এলাকায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সামান্য মূল্যে ইজারা দিয়ে বালু লুটপাট

জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা দুই দশকের বেশি সময় ধরে নদীর বিভিন্ন অংশে প্রায় দুই হাজার একর জায়গাজুড়ে পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা বারবার সামান্য মূল্যে ইজারা নিয়ে অবৈধভাবে শত শত ‘বাংলা ড্রেজার’ বসিয়ে বালু লুটপাট চালান। নদীর বুক খুঁড়ে প্রতিদিন তুলে নেন হাজার হাজার ট্রাক বালু, নুড়িপাথর আর কয়লা। বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকায় নদীটিকে রীতিমতো হত্যা করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপরিকল্পিত বালু তোলায় সোমেশ্বরীর শাখানদী আত্রাখালীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এলাকার শত শত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়ক। ওই সড়কে বালুবাহী ট্রাকচাপায় প্রতিবছর গড়ে ২৫ জনের প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটে। দিন–রাত ড্রেজারের উচ্চ শব্দে বহু মানুষের শ্রবণে সমস্যা দেখা দেয়। নদীতে থাকা দুলর্ভ মহাশোলসহ বহু প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে। জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে পেশার পরিবর্তন ঘটান। পর্যটকেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

বালু তোলা বন্ধ হওয়ায় আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে সোমেশ্বরী। নেত্রকোনার বিজয়পুর এলাকায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

এ নিয়ে প্রথম আলোয় সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর ‘লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসন ১৪৩১ বঙ্গাব্দের জন্য নদীতে বালুমহাল ইজারার দরপত্র আহ্বান করলে ইজারার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি সম্পূরক আবেদন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি দরপত্রসংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এরপর থেকে বালুমহাল ইজারা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে সম্প্রতি এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল আবারও বালু তোলার অনুমোদনের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

নেত্রকোনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলায় নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ হারিয়ে গেছে। এক বছর ড্রেজার না বসানোয় কিছুটা স্বাভাবিক দিকে যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু স্থানে পলি জমে ভরাট হয়ে আছে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি সমীক্ষা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রশাসন কঠোর অবস্থানে

ভবানীপুর বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় প্রায় এক যুগ ধরে ফেরি নৌকা চালান রহমত আলী। তিনি বলেন, ‘ইবার নদী ইজারা না দেওয়ায় খুব বালা হইছে। নদীডা অহন আস্তে আস্তে ঠিক হইয়া যাইব। ইজারা দিলে বাংলা ড্রেজার দিয়া বালু তোলে জায়গায় জাগায় বালুর স্তূপ আর গর্ত থাহে। নাও চালাইতে পারি না।’ তবে তিনি জানান, অনেকে রাতের বেলায় লুকিয়ে কিছু বালু উত্তোলন করে লরিতে করে পরিবহন করে থাকে।

অবশ্য জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, আদালতের নির্দেশে সোমেশ্বরী নদীর বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে মাঝেমধ্যে বালু উত্তোলন করে থাকে। তখন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা করা হয়। প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

বালু তোলায় চিরচেনা রূপ হারিয়ে ফেলেছিল পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সোমেশ্বরী। নেত্রকোনার দুর্গাপূর এলাকায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

গত সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) নদীর বিরিশিরি সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ওই অংশে প্রায় ৪০০ মিটার প্রস্থ নদীটির ৩৫০ মিটার অংশই ধু ধু বালু। আর মাঝখানের ৫০ মিটার অংশে হাঁটুসমান হালকা পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। সেখানে তিনজন নারী ও দুজন পুরুষ বালু গর্ত করে পানি থেকে কয়লা সংগ্রহ করছেন। জানতে চাইলে তাঁদের মধ্যে থিউফিল রেমা (৫৬) নামের একজন বলেন, ‘অন্যান্য বছরের চেয়ে এইবার শুকনা সময় নদীডাতে একটু পানি আছে মনে হইতাছে। অহন বালু না তোলনে আমরার লাইগ্যা বালা হইছে। আগে বালুর ড্রেজার আর ট্রাকের লাইগ্যা অতিষ্ঠ থাকতাম। মনে হইতাছে নদী আস্তে আস্তে ঠিক হইয়া যাইব।’ খুঁজিউড়া গ্রামের ট্রলারচালক নজরুল ইসলামও মনে করেন, নির্বিচার বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলে এবং খনন করলে নদীটি একসময় আপন বেগে ছুটবে। তখন সহজেই নৌকা চালানো যাবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সোমেশ্বরী নদীটি একটি পর্যটন আকর্ষণ। বালু আর পাথর ব্যবসার নামে নদীটিকে ধ্বংস করেছিল রাজনৈতিক প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে নদীটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নদীটিকে বালু আর পাথরদস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।