প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে খুলনার দাকোপ উপজেলার পাঁচটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকতে শুরু করে নোনাপানি। এর মধ্যে অন্তত চারটি স্থানে বাঁধ সংস্কার করে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে নোনাপানির প্রবেশ ঠেকিয়ে দেন এলাকাবাসী। শুধু একটি জায়গার বাঁধ আবার ভেঙে যাওয়ায় সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।
গতকাল সোমবার দাকোপের কাজীবাছা নদীর খলিশা ও পানখালী বাঁধের ভাঙন ঠেকিয়ে দেন স্থানীয় লোকজন। উপজেলার বটবুনিয়া বাজার-সংলগ্ন ঢাকী নদীর ভাঙন দেখা দেওয়া দুই জায়গার বাঁধও নিজেদের শ্রম ঘামে বেঁধে ফেলেন। কিন্তু দুপুরের জোয়ারে সেখানকার একটি জায়গা আবার ভেঙে যায়।
আজ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কাজ করে সেই স্থান মেরামত করে নোনাপানির প্রবেশ ঠেকান এলাকাবাসী।
আজ সকালে ভাঙন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নোনাপানি আটকানোর চেষ্টায় কাজ করছেন শত শত মানুষ। কেউ কোদাল দিয়ে মাটি কাটছেন। সেই মাটি লম্বা সারি করে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের হাতে দিচ্ছেন। বাঁধের কাছে দাঁড়ানো কিছু মানুষ সেই মাটি দিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে নারীদেরও কাজ করতে দেখা গেল।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডল, তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীন গাজীসহ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সংসদ সদস্যকে কাছে পেয়ে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী পাউবো ও ঠিকাদারের লোকজনের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দুপুর ১২টা নাগাদ নদীতে জোয়ার এলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার আগেই লবণপানির প্রবেশ বন্ধ করা গেছে।
স্বেচ্ছাশ্রমে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করছিলেন তিলডাঙ্গা ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সঞ্জয় সরদার। কাজের ফাঁকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৭০০ লোক স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। গতকাল সবাই মিলে শ্রম দিয়ে নোনাপানির প্রবেশ বন্ধ করা গিয়েছিল। কিন্তু দুপুরের জোয়ারে ভেঙে যাওয়া দুটি জায়গার মধ্যে একটি আবার ভেঙে যায়। গতকাল বিনা মূল্যে শ্রম দিয়েছেন এলাকাবাসী। আজ ঘণ্টায় ৭০ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান।
তবে মজুরি কিংবা টাকাপয়সা নিয়ে ভাবছেন না এলাকাবাসী। স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা অসিত সরদার ও শশাঙ্ক রায় বললেন, টাকাপয়সা নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। তাঁরা চান, এলাকায় যাতে দ্রুত লবণপানির প্রবেশ বন্ধ হয়। দ্রুত আটকানো না গেলে ভাঙনের জায়গা জোয়ারে বড় হয়ে গেলে স্বেচ্ছাশ্রমে আর পানি আটকানোর মতো অবস্থা থাকে না।
সাময়িকভাবে পানি আটকানো সম্ভব হলেও আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাঁধটি মজবুত করে সংস্কার না করলে আবার ভাঙন দেখা দেবে বলে মত দিয়েছেন কয়েকজন বাসিন্দা। সুশান্ত সরদার নামের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে এখন গোণমুখ না (পূর্ণিমা বা অমাবস্যার আগের দুই দিন থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার পরের চার থেকে পাঁচ দিন)। এখন পানির চাপ কম থাকবে। তবে ছয়–সাত দিন পর জোয়ারের চাপ বাড়বে। এই সময়ের মধ্যে বাঁধ মজবুত না করলে আবার সমস্যা হবে।’
৩১ নম্বর পোল্ডারে বটবুনিয়া বাজারের বাঁধ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দোকানি গোপাল বিশ্বাস। ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘দীর্ঘদিন এখানে রাস্তার খারাপ অবস্থা ছিল। একটা প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু ঠিকাদার ঠিকমতো কাজ করে না। পাউবো কোনো দিন খেয়ালও করে না, আদৌ কোনো কাজ হচ্ছে কি না।’
পাউবো সূত্র জানায়, ৩১ নম্বর পোল্ডারে জাইকার অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৭৫০ মিটার স্থায়ী নদীশাসনের কাজ চলছে। বটবুনিয়া বাজার ও কামিনিবাসিয়ায় ভাঙন এলাকায় যথাক্রমে ৫০০ মিটার ও আড়াই হাজার মিটার জায়গা নদীশাসনের কাজ চলমান। এর মধ্যে দুটি জায়গার তিনটি পয়েন্টে ভেঙেছে।
খুলনা পওর বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দাকোপের খলিশা, পানখালী, বটবুনিয়ার দুটি পয়েন্ট ও কামিনিবাসিয়া; পাইকগাছার তেলিখালী ও কয়রার দশালিয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়েছে। এই সাত জায়গায় ১৫০ মিটারের মতো বাঁধ ভেঙেছে। এ ছাড়া দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা ও পাইকগাছায় আরও ৬০টি পয়েন্টে পানি উপচে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে চার উপজেলায় ৬২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আশরাফুল আলম আরও বলেন, দাকোপের কামিনিবাসিয়া, পাইকগাছার তেলিখালী ও কয়রার দশালিয়া—তিন জায়গায় ভাঙন আটকানো এখনো সম্ভব হয়নি। অন্য জায়গা দিয়ে আর পানি ঢুকতে পারছে না। দ্রুত ওই তিন জায়গা সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে। পাউবোর সহায়তার ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, জিও ব্যাগ, সিনথেটিক ব্যাগ, বাঁশ, কাঠ দিয়ে জনগণের সহায়তায় বাঁধের সংস্কার চলছে।
খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সরকারি হিসাবে প্রায় ৭৭ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৫৬ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ে খুলনার বটিয়াঘাটায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। সাত জায়গায় বাঁধ ভেঙে বিলীন হয়েছে। প্রায় ২৪৬ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।