পরিবেশগত সংকটাপন্ন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ রক্ষায় পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করা হলেও থেমে নেই অবৈধ দোকানপাট, রিসোর্ট ও কটেজ নির্মাণ। সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রসৈকতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে সাইকেল, মোটরসাইকেল ও রিকশা-ভ্যান।
বঙ্গোপসাগরে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এর মধ্যভাগে গলাচিপা থেকে দক্ষিণ দিকে দিয়ারমাথা সৈকত পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার ভ্রমণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ দিয়ামাথা সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ৪৫টির বেশি দোকানপাট। অন্যান্য এলাকায় তৈরি হচ্ছে ২০টি কটেজ-রিসোর্ট। ৮ ও ৯ ডিসেম্বর সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা যায়।
সরেজমিনে দিয়ারমাথা সৈকতে পরিবেশ অধিদপ্তরের বড় একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। তাতে লেখা আছে—‘সতর্কীকরণ-সৈকতে সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান চালানো সম্পূর্ণ নিষেধ। সাইনবোর্ডের তিন পাশে বাঁশ আর নারকেলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি হয়েছে ৪৫টির বেশি অস্থায়ী দোকানপাট। দোকানে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে বিক্রি হচ্ছে খাদ্যসামগ্রী। দোকানের সামনে রাখা আছে ৩০টির বেশি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-টমটম। সেন্ট মার্টিন বাজার থেকে পর্যটকেরা টমটমে উঠে বালুচর দিয়ে সোজা চলে যাচ্ছেন চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের দিয়ারমাথাতে। সেখান থেকে হেঁটে কেউ স্পিডবোটে চড়ে ছুটছেন ছেঁড়াদিয়া, মাঝেরদিয়া ও দিয়ারমাথা দ্বীপে।
টমটমচালক ও স্থানীয় মাঝের পাড়ার বাসিন্দা রহিম উল্লাহ (৪৫) বলেন, আগে দল বেঁধে পর্যটকেরা ইঞ্জিনচালিত নৌযানে সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট থেকে ছেঁড়াদিয়া ভ্রমণে যেতেন। এখন পর্যটক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নৌযানে ছেঁড়াদিয়ায় ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছে। কিছু পর্যটক টমটমে চড়ে দিয়ারমাথা আসছেন। কেউ স্পিডবোটে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছেঁড়াদিয়া যাচ্ছেন। সেখানে ছেঁড়াদিয়াতে লোক পারাপারের ৯টি স্পিডবোট দেখা যায়। মাথাপিছু ২০০ টাকা করে নিয়ে ছেঁড়াদিয়াতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
আমান উল্লাহ (৪৫) নামের এক ব্যক্তি স্পিডবোট পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও পেটের দায়ে তাঁদের এই ব্যবসায় নামতে হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে ছেঁড়াদিয়া যাতায়াত প্রসঙ্গে ঢাকার কমলাপুরের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান (৩৫) বলেন, সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে এসে ছেঁড়াদিয়া দেখার লোভ সামলানো কঠিন। নিষেধাজ্ঞার কথা তাঁদের জানা নেই।
গলাচিপার পূর্ব সৈকতের নারকেলবাগানের ভেতরে নতুন করে তৈরি হয়েছে একাধিক রিসোর্ট। ফটকে টাঙানো হয় সাইনবোর্ড—‘চাঁদের বাড়ি-বিচ রিসোর্ট’। জোয়ারের পানিতে কটেজ যেন বিলীন না হয়, সে লক্ষ্যে পাশের সৈকত থেকে পাথর তুলে এনে সীমানাতে প্রতিরক্ষা বাঁধ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জেলে সাইফুল আলম (৪৫) বলেন, ঢাকার একজন ব্যবসায়ী গত বছর নারকেলবাগান কিনেছেন। কয়েক মাস আগে কিছু নারকেলগাছ কেটে দুইতলা কয়েকটি রিসোর্ট তৈরি করেন। ১ ডিসেম্বর থেকে পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য কক্ষ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যার পর রিসোর্টের আলোয় সৈকত আলোকিত হয়ে পড়ে। রিসোর্টে মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। কর্মচারীরাও রিসোর্ট নির্মাণের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, কেয়াবন কিংবা নারকেলবাগান কেটে রিসোর্ট-কটেজ নির্মাণ চলছে অতি গোপনে। দ্বীপের বাইরের লোকজন এসব রিসোর্টের মালিক। অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের অনুমতি লাগে। কিন্তু তাঁরা অনুমতি দেন না।
দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ার সর্বশেষ প্রান্তের সৈকতে কয়েক বছর আগে তৈরি হয়েছে সিন্দাবাদ নামে একটি রিসোর্ট। সেখানেও পাশে নতুন করে রিসোর্ট তৈরি করতে দেখা গেছে। গলাচিপার পশ্চিম সৈকতেও দেখা যায় কয়েকটি কটেজ-রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ। দ্বীপের মধ্যভাগের গলাচিপা থেকে দক্ষিণ দিকে দিয়ারমাথা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণও নিষিদ্ধ। কারণ, সেখানে কচ্ছপ ডিম পাড়তে যায়। অথচ সরকারি আইন লঙ্ঘন করে সেখানে বহিরাগত প্রভাবশালীরা কয়েক বছরে ৪০-৪৫টি রিসোর্ট-কটেজ তৈরি করেছেন। এখন আরও ২০-২৫টি রিসোর্টে সংস্কার ও বর্ধিতকরণের কাজ চলছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) মতে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ) এই দ্বীপে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যেখানে দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে। এখানে কোনো প্রকার অবকাঠামো নির্মাণও করা যাবে না। আর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্রও দিতে পারে না।
তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবনও
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ওঠানামার জেটির পশ্চিম পাশে শতাধিক দোকানপাটের সেন্ট মার্টিন প্রধান বাজার। বাজারের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে নারকেলগাছ কেটে দুই দশকে তৈরি হয়েছে শতাধিক বহুতল ভবনের হোটেল-রিসোর্ট। বাজারের উত্তর পাশে তিনতলা আবাসিক হোটেল ব্লু-মেরিন। হোটেলটিতে কক্ষ আছে ৫৫টির বেশি। ভাড়া ৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। হোটেলের মালিক চাঁদপুরের আবু জাফর পাটোয়ারী। ১৯৯০ সালে তিনি ৪১ শতক জমি কেনেন। ২০০৩ সালে সেই জমিতে নির্মাণ করেন হোটেলটি। সরকারি আইন অমান্য করে হোটেল নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে আবু জাফর পাটোয়ারী বলেন, যে সময় হোটেল তৈরি হয়, তখন কোনো নীতিমালা ছিল না।
ব্লু-মেরিন হোটেলের পশ্চিম পাশে তৈরি হচ্ছে তিনতলা আরেকটি ভবন। নির্মাণশ্রমিকেরা জানান, ঢাকার এক ব্যক্তি জমি কিনে হোটেল বানাচ্ছেন। ভবন তদারকির দায়িত্বে থাকা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, তিন মাস ধরে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ইট-সিমেন্ট-রড আনা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে। এ পর্যন্ত কেউ বাধা দেয়নি।
দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে জমি কিনে তিনতলার কিংশুক হোটেল নির্মাণ করেন ঢাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সরোয়ার। তিনি বলেন, আইন লঙ্ঘন করে গলাচিপায় পরিবেশ অধিদপ্তর বহুতল ভবনের কার্যালয়, সৈকততীরে পুলিশ-কোস্টগার্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বড় বড় ভবন তৈরি করেছে। তারা যদি পারে ব্যবসায়ীরা কেন পারবেন না। আইন সবার জন্য সমান।
সেন্ট মার্টিন হোটেল রিসোর্ট কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম জিহাদী বলেন, দ্বীপে ২৩০টির মতো আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ তৈরি হয়েছে। রেস্তোরাঁ আছে প্রায় ২০০টি। কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। পর্যটক সীমিত করায় দেড় শতাধিক হোটেল রিসোর্ট কটেজ খালি পড়ে আছে।
সেন্ট মার্টিনে কথা হয় পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মো. সোলায়মান হায়দারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে আইন লঙ্ঘন করে দ্বীপে বহু হোটেল-রিসোর্ট, কটেজ-রেস্তোরাঁ নির্মাণ হয়েছে। এখন নতুন করে কাউকে অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হবে না। দিয়ারমাথা সৈকতসহ ভ্রমণ নিষিদ্ধ এলাকায় অবৈধভাবে যেসব অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে, সেসব উচ্ছেদ করা হবে।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পর্যটক সীমিত রাখার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে। বিধিনিষেধ মেনে গত ১ নভেম্বর থেকে দৈনিক দুই হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাচ্ছেন। অর্ধেক পর্যটক রাত যাপনের জন্য দ্বীপে অবস্থান করলেও বাকিরা একই জাহাজে কক্সবাজার ফিরে আসছেন। সীমিত আকারে পর্যটকের উপস্থিতিতে নাখোশ সেখানকার হোটেল রিসোর্ট কটেজ মালিকেরা। তাঁদের দাবি, যে পরিমাণ পর্যটক দ্বীপে অবস্থান করেন, তাতে দেড় শতাধিক হোটেল রিসোর্ট কটেজ খালি যাচ্ছে, লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁদের। এমনই যদি হয় তবে আরও রিসোর্ট-কটেজ, দোকানপাট নির্মাণ করা হচ্ছে কেন? কারা এতে সহায়তা দেয়। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।