আট মাস ধরে হাসপাতালের মেঝেতে সন্তান নিয়ে দিন কাটছে নারীর
নড়াইল সদর হাসপাতালের নিচতলায় গাইনি বিভাগ। বিভাগে ঢোকার আগে সিঁড়ির নিচে মেঝেতে বিছানা পেতে বসে আছেন একজন নারী। সঙ্গে শিশুসন্তান। মেঝেতে তোশকের ওপর সাদা চাদর পাতা। দেখে বোঝা যায়, হাসপাতালের জিনিস। পাশাপাশি রয়েছে একটি মশারি, ছোট একটি ফ্যান, বালতিসহ টুকিটাকি জিনিস। যেন এখানেই তাঁর ঘরবাড়ি, এখানেই সংসার।
আট মাস ধরে নড়াইল সদর হাসপাতালে রয়েছেন এই নারী। হাসপাতালের খাবার ও মানুষের দেওয়া সহযোগিতায় তাঁর দিন কাটছে। কিন্তু তিনি তাঁর পরিচয় বা বাড়ির ঠিকানা কিছুই বলতে পারেন না।
গতকাল রোববার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ওই নারীকে দেখতে সিঁড়ির পাশে কয়েকজন ভিড় করছেন। অনেকেই কথা বলার চেষ্টা করছেন। তবে এতে তাঁর আগ্রহ নেই। তিনি নিজের মতো করে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সন্তানের যত্নে কোনো কমতি নেই। কিছু সময় পরই সন্তানকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। এ সময় ওই নারী বলেন, প্রতিদিন সকালের দিকে বাচ্চা নিয়ে বাইরে চলে যান তিনি। বিকেলে আবার হাসপাতালে ফিরে আসেন। গতকাল হাসপাতালে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় একজন বলে গেছেন, তাঁর আর এখানে থাকা যাবে না। এখান থেকে তাঁর মাল-জিনিসও মানুষ নিয়ে যায়। এভাবে থাকতে তাঁর কষ্ট হয়। একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা হলে সন্তান নিয়ে একটু ভালো থাকতেন তিনি।
হাসপাতালের নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর নভেম্বরের ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় নড়াইল সার্কিট হাউসের গেটের পাশে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ওই নারী। পরে তাঁকে উদ্ধার করে প্রশাসনের সহযোগিতায় নড়াইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। এর পর থেকে ওই নারীর নিয়মিত খোঁজখবর রাখে সংগঠনটি। ওই নারী মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। তবে সন্তানের যত্নে তাঁর কোনো ত্রুটি নেই।
তবে ওই নারীর হাসপাতালে থাকেন, বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল গফফার। এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
সন্তান প্রসবের পর ওই নারীকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুজল কুমার বকশী। সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে তাঁর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই নারী এখানেই (হাসপাতালে) আছেন। আগামীকাল খোঁজ-খবর নিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন।
স্বপ্নের খোঁজে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মির্জা গালিব বলেন, ‘সেদিন আমরা ওই নারী ও তাঁর সন্তানকে উদ্ধার করে প্রশাসনের সহযোগিতায় হাসপাতালে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে তাঁর পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তার পর থেকে আমি নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর রাখি। ওই নারী রাতে হাসপাতালে একটি সিঁড়ির নিচে থাকে। দিনের বেলা শহরের পুরোনো বাস টার্মিনাল এলাকায় থাকে। হাসপাতাল থেকে মাঝেমধ্যে তাঁকে বের করে দিলেও তিনি আবার ফিরে আসেন। অনেকেই তাঁকে কমবেশি সাহায্য করেন। আমি প্রতি সপ্তাহে এসে দেখা করে যাই এবং কিছু খরচ দিয়ে যাই। তাঁর একটি স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য অনেক দপ্তরে দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু কারও থেকে কোনো সাড়া পাইনি।’
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রতন কুমার হালদার বলেন, শুরু থেকেই ওই নারীর খোঁজখবর রেখেছেন তাঁরা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসন করার চেষ্টাও করেছেন। প্রথমে ওই নারীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর পরিবারের ঠিকানা ও তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সে কোনো তথ্য দেয় না। পরে ওই নারী ও তাঁর সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুনর্বাসনের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে কোনো অবস্থাতেই কোথাও যেতে রাজি হয় না। ফলে তাঁর পুনর্বাসন করা সম্ভব হচ্ছে না।