ঈদের আগে বগুড়ার ‘বেনারসি শাড়ি গ্রামের’ হাল-চাল

বগুড়ার শেরপুরের ঘোলাগাড়ি কলোনি গ্রামের বন্ধ হয়ে যাওয়া বেনারসি তাঁতছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ি কলোনি গ্রাম। উৎসব এলে এই গ্রামের মানুষের মধ্যে আনন্দ বয়ে যেত। মুখর হয়ে উঠত গ্রামের তাঁতগুলো। তাঁতের ‘ঠক, ঠক’ শব্দ কেমন ছন্দের মতো লাগত। এখন আর সেই দিন নেই। নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক তাঁত। কারিগরদের চোখেমুখে এখন দুশ্চিন্তার ছাপ।

তাঁতের কয়েকজন মালিক ও কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে এই গ্রামে তাঁতশিল্প গড়ে ওঠে। তখন ৭২টি তাঁত ছিল। কারিগর ছিলেন এই গ্রামেরই নারী ও পুরুষেরা। সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন অন্তত ১৫০ জন। ঢাকার মিরপুর-১২ নম্বর থেকে আনা সুতা ও শাড়ির নকশায় এই গ্রামে গড়ে ওঠে বেনারসি তাঁতশিল্প। অন্তত ১০ ধরনের বেনারসি শাড়ি তৈরি হতো। দাম ছিল সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে।

গত সোমবার বিকেলে সরেজমিন গ্রামটিতে দেখা যায়, এখন তাঁত আছে ৪০টির মতো। সব কটি তাঁত এখন বন্ধ। এখানে আর কোনো বেনারসি শাড়ি তৈরি হয় না। ফলে শাড়ি নিতে আসা মানুষের আনাগোনাও নেই।

এ গ্রামের খোরশেদ আলম বলেন, মিরপুর থেকে তিনি বেনারসি শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ নেন পাঁচ বছর ধরে। পরে তিনি গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে ১৯৯৪ সালে পাঁচটি তাঁত বসান। গ্রামের নানাজন তাঁর কাছ থেকে শিখে তাঁত বসান। এভাবে একসময় এখানে ৭২টি তাঁত হয়। সারা বছর তাঁরা বেনারসি শাড়ি বানাতেন। দেশের বিভিন্ন বাজারে তাঁদের শাড়ির চাহিদাও ছিল অনেক। বগুড়াসহ আশপাশের জেলাগুলোর মানুষের কাছে গ্রামের নাম হয়ে যায় ‘বেনারসি শাড়ির গ্রাম’।

তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালিক-কারিগর সবাই দিনমজুর হয়ে গেছেন
ছবি: প্রথম আলো

খোরশেদ আলম বলেন, তাঁরা বেনারসি শাড়ি বানাতেন হাতে তৈরি মেশিন দিয়ে। একসময় ভারত থেকে বেনারসি শাড়ি আসা শুরু হলো। দেশের বাজারে সেসব শাড়ির চাহিদা বাড়ল। ফলে শেরপুরের গ্রামে বানানো বেনারসির চাহিদা কমতে থাকল। ২০০২ সাল পর্যন্ত তাঁদের ব্যবসা টিকে ছিল। এখানে উৎপাদন খরচসহ সব মিলিয়ে তাঁরা যে দামে শাড়ি বিক্রি করতেন, তার চেয়ে অনেক কম দামে ভারতীয় শাড়ি বিক্রি হতো। এভাবে একসময় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এখন গ্রামে একটি তাঁতও চলে না।

আরও পড়ুন

একসময় তিনটি তাঁতের মালিক ছিলেন এই গ্রামের জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর তাঁতগুলো বন্ধ। তিনি এখন হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। তাঁর তাঁতে ছিলেন দুজন কারিগর। তাঁরা এখন দিনমজুর। তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালিক-কারিগর, সবাই দিনমজুর হয়ে গেছেন। কেউ মিল–চাতালে দিনমজুরি করেন, কেউ রাজমিস্ত্রি কিংবা রিকশাচালক হিসেবে কাজ করছেন। গ্রামের নারীরা তাঁতে কাজ করে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতেন। তাঁরাও এখন কর্মহীন।

আবদুল ওয়াহেদ শেরপুরের এই গ্রামের তাঁতি সমিতির সাবেক সভাপতি। এখন স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার মানুষের আনন্দও হারিয়ে গেছে। এই ঈদুল ফিতরে হয়তো গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের ছেলেমেয়েরা নতুন জামা পাবে না।