শাল-গজারি বনে রং ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে বসন্ত

গাজীপুরের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে এখন শাল-গজারির ফুল ফুটেছেছবি: প্রথম আলো

প্রকৃতি থেকে বসন্ত বিদায় নিচ্ছে। আসছে গ্রীষ্ম। বসন্তের বিদায়বেলায় বিস্তৃত সবুজ শাল-গজারি বনে বাসন্তী রং ছড়াচ্ছে হলদে শাল-গজারি ফুল। গাজীপুরের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে এখন বসন্তের এই রং উৎসব চলছে। বিশেষ করে শ্রীপুর, গাজীপুর সদরের একাংশ, কাপাসিয়ার একাংশ ও কালিয়াকৈর উপজেলার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চলছে এই রঙের উৎসব।

শ্রীপুরের কর্ণপুর থেকে বরমী কিংবা হায়াতখার চালা থেকে গোসিংগা আঞ্চলিক সড়কের মতো অনেকগুলো সড়ক ভ্রমণ এখন যে কাউকে এক ব্যতিক্রমী বসন্তের অভিজ্ঞতা দেবে। বিশেষ করে এ সময় মাওনা থেকে কালিয়াকৈর উপজেলায় যাতায়াতের সড়কপথের পুরোটাই ফুলে ছেয়ে থাকে। এসব সড়কে ভ্রমণ করলে দেখা যায়, দুই পাশে শুকনা পাতার ওপর ছড়িয়ে আছে কাঁচা হলুদ রঙের শাল-গজারি ফুল। সঙ্গে আছে মোহনীয় গন্ধ।

শাল-গজারি বনের কোনো একটি গাছের মাথায় উঠে চারদিকে তাকালে মনে হবে, বনের গাছপালার ওপর কেউ যেন হলুদ রঙের মাদুর বিছিয়ে রেখেছে। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৌমাছিসহ নানা কীটপতঙ্গ। পাখিদের ওড়াউড়িতে বনজুড়ে যেন এক মহোৎসব চলছে। পাখির ডানা ঝাপটানো কিংবা হঠাৎ একটু দমকা বাতাসে গাছ থেকে নিচে ঝরে পড়ে হলুদ শাল-গজারি ফুল। বসন্তে গাছের সব পাতা ঝরে যাওয়ার পর গাছে থাকা হলুদ ফুলগুলো এক অনন্য সৌন্দর্য ছড়ায়।

প্রতিবছর বসন্তের মাঝামাঝি থেকে শাল-গজারিগাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। এরপর গাছ থেকে অপরিণত অবস্থায় বেশির ভাগ ফুল নিচে ঝরে পড়ে। থেকে যাওয়া ফুলগুলো বড় হয়। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এসব ফুল পরিণত হয়ে যায়। তখন এর রং হয় কিছুটা বাদামি।

পরিণত ফুলের আবার অন্য রকম সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। এসব ফুলের এক পাশে থাকে বীজ। আর অন্য পাশে ফুলের পাপড়ির মতো ছড়ানো বড় বড় পাতলা পাপড়ি। একসময় গাছ থেকে বীজসহ এসব ফুল ঝরে পড়ে। তখন বীজের এক পাশে থাকা পাপড়ির মতো অংশ বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে এলোমেলোভাবে দূরদূরান্তে বীজগুলোকে ছড়িয়ে দেয়।

বসন্তের এ সময় শাল-গজারি বনে বিভিন্ন ফুল ফোটে। এগুলোর মধ্যে আছে কনকচাঁপা, জারুল, শিমুল, শেফালি, শিরীষ, মান্দার, কামিনী, অতসী, দাঁতরাঙা, কাঞ্চন, বেলি, শটি, রঙ্গনসহ নানা ফুল।

শাল-গজারি বনের বর্ণিল বিভা বসন্তের সৌন্দর্যে যোগ করে নতুন মাত্রা
ছবি: প্রথম আলো

শ্রীপুরের বরমী এলাকার অশীতিপর বৃদ্ধ জমির আলী গল্প করতে করতে বলেন, একসময় বসন্তের শাল-গজারি ও অন্যান্য ফুলের ওপর নির্ভর করে গাছের খোঁড়লে (কোটর) ও শিকড়ের কাছাকাছি কিছু মৌমাছি বাসা বাঁধত। ছোট আকারের এসব মৌচাকের গঠনও ছিল কিছুটা ছোট। কিন্তু অন্যান্য মৌমাছির চেয়ে এসব মৌমাছির সংগ্রহ করা মধু ছিল অনেক মিষ্টি ও কিছুটা ঝাঁজালো স্বাদযুক্ত।

ছোট মৌচাক সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছেন গোসিংগা গ্রামের বৃদ্ধ মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গাছ আছে, বন আছে ঠিক। কিন্তু আগের সেই মৌমাছির বাসা নাই। এটা কেন নাই হয়ে গেছে, তা জানি না।’

ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হয়ে সবুজ প্রকৃতিতে হলুদ ফুলের সমারোহ দেখলে ভীষণ ভালো লাগে। এমন অনুভূতির কথা জানিয়েছেন গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের কর্মী চন্দন কুমার। তিনি বলেন, বনের ভেতরেই থাকেন। বসন্তের এ সময় গজারি ফুলের রং আর গন্ধ—দুটোই মন ভরিয়ে দেয়।

ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অসীম বিভাকর বলেন, প্রকৃতি অপার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে আবির্ভূত হয় বসন্তকালে। শাল-গজারি বনের বর্ণিল বিভা সেই সৌন্দর্যে যোগ করে নতুন মাত্রা। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বনভূমি এখন ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে। জীবনের প্রয়োজনেই ভাওয়ালগড়সহ সব বনভূমিকে রক্ষা করতে হবে।