নতুন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে আদালতের স্থগিতাদেশ, নৌরুটে চলবে ইজারাদারের নৌযান

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট। আজ সকাল ১০টায় তোলাপ্রথম আলো

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ও সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া (কুমিরা-গুপ্তছড়া) নৌপথে যাত্রী পরিবহনে অনুমতি পেয়েছিল ‘সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিস লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানি। তবে নতুন কোম্পানির কার্যক্রম আপাতত শুরু হচ্ছে না। ইজারাদারের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বিআইডব্লিউটিএর এই অনুমতির ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে, ১ জানুয়ারি সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিস লিমিটেডকে ছয়টি স্পিডবোটে যাত্রী পরিবহনের জন্য অনুমতি দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। পাশাপাশি কুমিরা ঘাট এলাকায় অস্থায়ী টিকিট কাউন্টার করার মৌখিক অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই কোম্পানিকে যাত্রী পরিবহনের জন্য টিকিটঘর নির্মাণে বাধা দেন ঘাটের বর্তমান ইজারাদার জগলুল হোসেনের লোকজন। এরপর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ৬ জানুয়ারি সন্দ্বীপ মেরিনের কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।

ইজারাদার জগলুল হোসেন জেলা পরিষদের পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে সন্দ্বীপ-গুপ্তছড়া ঘাট ইজারা নিয়েছেন। এ জন্য জেলা পরিষদকে দৈনিক ১ লাখ টাকা ও বিআইডব্লিউটিএকে বছরে ৭৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। নৌ রুটটিতে ইজারাদারের পরিচালিত নৌযান চলে। ভাড়াও ইজারাদার নির্ধারণ করেন। বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নিয়ে নতুন কোম্পানির নৌযান যাত্রী পরিবহন করলে এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। পরিবহনভাড়াও যৌক্তিক হবে। তবে ইজারাদারের দাবি, অন্য কোনো কোম্পানির নৌযান যাত্রী পরিবহন করলে তাঁর বিনিয়োগ উঠে আসবে না।

ইজারাদার জগলুল হোসেন দাবি করেন, নৌ রুটে অন্য কোম্পানির নৌযান চললে তাঁর বিশাল অঙ্কের ক্ষতি হবে। বিনিয়োগ তুলে আনতে ইজারার মেয়াদ পর্যন্ত এককভাবে নৌযান চালাতে চান তিনি। এ জন্য সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে আদলতে রিট আবেদন করেছিলেন তিনি।

সন্দ্বীপের বাসিন্দা, বিআইডব্লিউটিএ ও ইজারাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্দ্বীপের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র পথ নৌপথ। সীতাকুণ্ডের সঙ্গে সন্দ্বীপের ছয়টি নৌপথের চারটিই চালু রয়েছে। তবে উভয় দিকে সড়কব্যবস্থার উন্নত হওয়ায় কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌপথেই বেশি মানুষ যাতায়াত করে। এ কারণে এই নৌ রুট ইজারাদারের জন্য লাভজনক। নৌ রুটটিতে ইজারাদার এককভাবে নৌপথে যাত্রী পরিবহন করেন। ফলে যেমন ইচ্ছা ভাড়া আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। সন্দ্বীপের মানুষের দাবির মুখে একাধিকবার স্পিডবোটসহ নৌযানের ভাড়া বাড়ানো কমানো হয়েছে। একসময় স্পিডবোটের ভাড়া ছিল ৫০০ টাকা। এরপর একাধিক দফায় তা কমানো হয়। ৫ আগস্ট দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তা কমিয়ে ২৫০ টাকা করা হয়।

নতুন কোম্পানির কার্যক্রমের আদালতের নিষেধাজ্ঞার জারি নিয়ে ইজারাদারের ব্যানার
প্রথম আলো

ইজারাদার জগলুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন ঘাটের মালিকানা ছিল জেলা পরিষদের কাছে। ইজারা বাবদ জেলা পরিষদকে দৈনিক এক লাখ টাকা দিতে হচ্ছে তাঁর। সম্প্রতি উভয় পাশে বন্দর ঘোষণা হওয়ায় ঘাটের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএর কাছে। সে জন্য বার্ষিক ৭৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকেও ইজারা নেন। সে হিসাবে তাঁর দৈনিক ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ইজারার খরচ এবং আরও ৮০ হাজার টাকা কর্মীদের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। এর আগে ভাড়া ছিল ৩৮০ টাকা। তখন ক্ষতি কোনোমতে পুষিয়ে নিতেন। কিন্তু তিন মাস আগে আন্দোলনের মুখে ভাড়া কমিয়ে ২৫০ টাকা করা হয়। এ কারণে গত তিন মাসে তাঁর ৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন কোম্পানি যাত্রী পরিবহন করলে তাঁর লোকসান হবে।

জগলুল হোসেন বলেন, ৬ জানুয়ারি সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিসের কার্যক্রম বন্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। আদালত ওই কোম্পানির কার্যক্রম দুই মাসের জন্য স্থগিত করেন। বিষয়টি তিনি বিআইডব্লিউটিএ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সব দপ্তরে জানিয়েছেন।

সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিসকে যাত্রী পরিবহনের জন্য বিআইডব্লিউটিএ দুটি চিঠি দিয়েছে। যার একটি স্পিডবোট চালানোর অনুমতি ও অন্যটিতে ইজারাদারকে শুল্ক পরিশোধ করার নির্দেশনা রয়েছে। চিঠি দুটিতে দেখা গেছে, ১ জানুয়ারি থেকে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যাত্রী পরিবহনের জন্য সামরিক রুট পারমিট ও সময়সূচি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা করে এবং প্রতিবার ঘাটে স্পিডবোট ভেড়ানোর জন্য ৭৫ টাকা করে ইজারাদারকে শুল্ক পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সন্দ্বীপের মানুষ ফিটনেসযুক্ত নিরাপদ নৌযানের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষের নৌ-যাতায়াতের দুর্ভোগ কমাতে তাঁরা ছয়টি স্পিডবোট কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌপথে চালানোর জন্য তৈরি করেন। ১ জানুয়ারি বিআইডব্লিউটিএ সেগুলোর লাইসেন্সও দেয়। ৪ জানুয়ারি তাঁদের লোকজন কাউন্টার স্থাপন করতে গেলে বর্তমান ইজারাদারের লোকজন বাধা দেন। বিষয়টি তাঁরা বিআইডব্লিউটিএকে জানানোর পর ইজারাদারকে দেওয়ার জন্য শুল্ক নির্ধারণ করে ৫ জানুয়ারি আরও একটি চিঠি দেন। এরপর ইজারাদার আদালতে গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে রিট করেছেন বলে শুনেছেন। কাগজপত্র পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা তাঁরাও নেবেন বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সাল থেকে জেলা পরিষদ কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের ইজারা দিয়ে আসছে। তবে ২০০৯ সালে ঘাটের মালিকানা দাবি করে বিআইডব্লিউটিএ। এর পর থেকে এ দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার দ্বন্দ্ব চলমান। এর মধ্যে ২০২০ সালের ১ মার্চ সীতাকুণ্ড অংশে ( মিরসরাই-রাসমনি) নদীবন্দর ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর সন্দ্বীপকে উপকূলীয় নদীবন্দর ঘোষণা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঘাটে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জেটি, যাত্রীছাউনিসহ যাত্রী পারাপারের সুবিধায় নির্মিত স্থাপনাগুলোয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব বাতিল বলে গণ্য হবে। সেদিন থেকে জেলা পরিষদের কর্তৃত্ব বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু এখনো জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘাটের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর কাছে হস্তান্তর করেনি।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌপথের মালিক বিআইডব্লিউটিএ। তাদের অনুমোদিত একাধিক নৌযান মালিক নির্ধারিত শুল্ক ইজারাদারকে পরিশোধ করে নৌযান চালাতে কোনো বাধা নেই। এতে ইজারাদারের কোনো ধরনের লোকসান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ইজারাদার যদি পুরোনো দিনের মতো জেলা পরিষদকে কোনো ধরনের অর্থ দিয়ে লোকসানে পড়েন, সেটি তাঁর ব্যাপার। তিনি শুনেছেন, ইজারাদার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য আদালতে রিট করেছেন। বিষয়টি তাঁদের আইন কর্মকর্তা দেখছেন। রিটের আগে কুমিরা ঘাটে সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিসকে মৌখিকভাবে কাউন্টার তৈরির অনুমতি দিয়েছেন।

অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য চিঠি

এদিকে কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌপথে চলাচলকারী অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য সন্দ্বীপ ও সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। গতকাল রোববার এই চিঠি দেন বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। ইজারাদার সূত্র জানিয়েছে, ঘাটে ২০টি স্পিডবোট, কাঠের তৈরি ৩টি ট্রলার দিয়ে যাত্রী পারাপার করেন ইজারাদার। এ ছাড়া মালামালের ট্রলারেও যাত্রী পারাপার হয়।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে, কাঠের তৈরি ট্রলার ও লাইফবোট চলাচল সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ১৩টি স্পিডবোটের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া ৬টি স্পিডবোট এখনো সাগরে নামানো হয়নি।

সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম ও সন্দ্বীপের ইউএনও রিগ্যান চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, কুমিরা গুপ্তছড়া নৌপথে অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআইডব্লিউটিএর চিঠি তাঁরা পেয়েছেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আলোচনা করে যেকোনো দিন অভিযান পরিচালনা করা হবে।