‘ভিটের ওপর জোয়ার-ভাটা খেলছে, কয়েক দিন ধরে রান্না নেই’

টানা বৃষ্টি ও জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল। সোমবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন তেঁতুলতলার চর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

টানা বৃষ্টি ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনসহ খুলনার উপকূলীয় কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন হাজারখানেক মানুষ। ভেসে গেছে শতাধিক মাছের ঘের, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। সুন্দরবনেরও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

কয়রা আবহাওয়া কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসানুল বান্না বলেন, গত ৪৮ ঘণ্টায় সুন্দরবন উপকূলে ২৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ধীরে ধীরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে পারে বলে জানান তিনি।

বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জোয়ারের সময় পানিতে তিন দিন ধরে প্লাবিত হচ্ছে কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের তেঁতুলতলার চর, শেখের গ্রাম, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, বাগালী ইউনিয়নের শেওড়া গুচ্ছগ্রাম, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ী, দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের জোড়শিং, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর কয়রা ও খুঁটিঘাটা গ্রামের কিছু অংশ। এসব এলাকার বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। তবে ভাটার সময় পানি নেমে যাওয়ায় লোকজন বাড়িতেই থাকছেন।

সোমবার সকালে কয়রার তেঁতুলতলার চর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের বাইরে কয়রা নদীর চরে তিন শতাধিক পরিবার বাস করে। চরের বসতির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদীর আরেক পাড়ে সুন্দরবন। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে গ্রামটি। ওপারের সুন্দরবনের মধ্যেও জোয়ারের পানি থইথই করছে।

আমেনা বেগম বলেন, ‘আমাগে থাকবার মতো আর কোনো জায়গা নাই, রান্নাঘরের সব পানিতে চলে গেছে। জ্বালানি সব ভেসে গেছে। ভিটের ওপর জোয়ার-ভাটা খেলছে। কয়েক দিন ধরে কোনো রান্না নেই। চিড়া-মুড়ি খেয়ে থাকতে হচ্ছে।’

সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার বলেন, জোয়ারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে সুন্দরবনের নদ-নদীগুলোয়। পানিতে বনের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যাচ্ছে। বন্য প্রাণীর আবাসস্থল তলিয়ে যাওয়ায় বনের মধ্যে টহল ফাঁড়িগুলোর উঁচু পুকুরপাড়ে হরিণের পালকে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। তবে এখনো বন্য প্রাণীর ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের প্রাণীগুলো এই প্রকৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত। অতিরিক্ত উচ্চতার জোয়ারের কারণে বনের অভ্যন্তরে পানি কিছুটা বাড়লেও ভাটার সময় নেমে যাচ্ছে। বনের অভ্যন্তরে উঁচু টিলা আছে। জোয়ারের সময় বন্য প্রাণীরা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয়। যেহেতু ভাটার সময় পানি নেমে যাচ্ছে, তাই জোয়ারে বন্য প্রাণীদের কিছু সমস্যা হলেও বড় ধরনের ক্ষতি হবে না বলেই ধারণা তাঁর।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলায় দুটি পোল্ডারে পাউবোর ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে এসব বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লোনাপানি প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় লোকজনও প্রস্তুত রয়েছেন। গত দুই দিন নদীতে জোয়ারের সময় ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে বাঁধ পাহারা দিচ্ছেন তাঁরা। কয়েকটি স্থানের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে সংস্কার করেছেন গ্রামবাসী।

আরও পড়ুন

কয়রায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো হচ্ছে মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, গোবিন্দপুর, মঠবাড়ী ও পবনা; কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, হরিণখোলা, ঘাটাখালী, ৪ নম্বর কয়রা ও ২ নম্বর কয়রা খালের গোড়াসংলগ্ন এলাকা; মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখের কোনা,  নয়ানী; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাঠকাটা, কাশিরহাটখোলা, হরিহরপুর, কাটমারচর ও পুটিরঘেরী; দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চরামুখা, বীণাপাণি, জোড়শিং ও আংটিহারা।

এসব বাঁধের খুব বেশি সমস্যা হবে না জানিয়ে খুলনা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেন, বর্তমানে কয়রায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের বেশি বাঁধের সংস্কারকাজ চলছে। এ ছাড়া কয়রার দুটি পোল্ডারের বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অতিবৃষ্টি ও সাগর উত্তাল থাকার কারণে সুন্দরবন ও উপকূলের সব নদ-নদীতে স্বাভাবিকের তুলনায় পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে পানির চাপ গত দুই দিনের তুলনায় আজ কিছুটা কমেছে। ফলে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা কম।