যে সন্তানের জন্য জীবনযুদ্ধ, তাকেই হারালেন রিমা
রিমা আক্তার ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ছেলের জন্মের কিছুদিন পরে বাবার বাড়িতে সন্তান ও তাঁকে রেখে উধাও হন স্বামী আমিনার রহমান। পাথরশ্রমিক বাবার টানাপোড়েনের সংসারে ছোট্ট শিশুটিকে রেখে নিজেও দিনমজুরের কাজ করতে শুরু করেন রিমা। ছেলে রোমান কিছুটা বড় হলে তাকে নানা-নানির কাছে রেখে রিমা পাড়ি জমান ঢাকায়। সেখানে কাজ নেন একটি তৈরিপোশাক কারখানায়। যে সন্তানকে মানুষ করতে রিমা আক্তারের এই জীবনযুদ্ধ, অবশেষে সেই অন্ধের ষষ্ঠী রোমান (৮) মারা গেছে পুকুরের পানিতে ডুবে। একমাত্র অবলম্বন ছেলেটিকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় রিমা।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর-বগুলাহাটি এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
নানা-নানির কাছে থাকা শিশু রোমান নিখোঁজ হয়েছিল শুক্রবার দুপুরে। সারা দিন খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বাড়ির কাছাকাছি একটি পুকুর (পাথর উত্তোলনের গর্ত) থেকে উদ্ধার করা হয় রোমানের লাশ। মারা যাওয়া শিশু রোমান স্থানীয় ভুতিপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র।
শিশুটির পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবির আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মা রিমা আক্তার ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করার কারণে তাঁর শিশুপুত্র রোমান নানা বুধু মোহাম্মদের কাছে থাকত। শুক্রবার দুপুর ১২টার পর থেকে রোমানকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না পরিবারের লোকজন। শিশুটিকে খুঁজে পেতে বিকেলে মাইকিংও করা হয়েছিল। পরে ইফতারের পর স্থানীয় কয়েকটি শিশু জানায়, রোমান তাদের সঙ্গে বাড়ির কাছাকাছি একটি পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল। গোসল শেষে অন্য শিশুরা যে যার মতো বাড়িতে চলে এসেছিল। পরে ওই শিশুদের কথা অনুযায়ী সন্ধ্যায় পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট ওই পুকুরপাড়ে শিশুটির জামাকাপড় পাওয়া যায়। পরে স্থানীয় লোকজন পুকুরে নেমে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে রোমানকে মৃত অবস্থায় পেয়ে পুলিশকে জানায়।
ইউপি সদস্য আবির আলী আরও জানান, শিশু রোমানের বাবা আমিনার রহমানের বাড়ি জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায়। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন তিনি। ছেলের জন্মের কিছুদিন পরেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান আমিনার। এরপর ওই শিশুকে নিয়ে শুরু হয় রিমা আক্তারের জীবনযুদ্ধ। পরে শিশুটিকে তার নানা-নানির কাছে রেখে রিমা ঢাকায় গিয়ে একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। এর মধ্যে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন ছেলেকে। শুক্রবার ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। আজ শনিবার সকালে রিমা আক্তার বাড়িতে পৌঁছার পর বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় গোরস্তানে শিশুটির লাশ দাফন করা হয়েছে।
শিশুটির নানা (মায়ের চাচা) আনারুল ইসলাম বলেন, ‘পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে। স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলেটাই ছিল রিমার একমাত্র অবলম্বন। অবশেষে তাকেও হারাল সে। ছেলেকে হারিয়ে এখন দিশেহারা রিমা।’
তেঁতুলিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুসা মিয়া বলেন, পুকুরের পানিতে ডুবে ওই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে।