কয়রার বিস্তীর্ণ মাঠে শর্ষে ফুলের হাসি
নীল আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ঢাকা পড়েছে শর্ষে ফুলের হলদে আবরণে। পৌষের শেষ ভাগে শীতের শুষ্কতায় এ রকম হলুদের গালিচা মোড়ানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখে যে কারোরই মন ও চোখ জুড়িয়ে যাবে। খুলনার কয়রা উপজেলার কাটমারচর গ্রামের বিলে বুধবার সকালে এমন চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখা গেছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের চোখে–মুখেও আনন্দের রেখা ফুটেছে। প্রতিদিনই প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণপিপাসু নারী-পুরুষ শর্ষের মাঠে গিয়ে ছবি তুলছেন।
কয়রার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী কাটমারচর গ্রামের বিলে প্রায় দেড় শ বিঘা জমিতে শর্ষে আবাদ করেছেন ৫৮ জন কৃষক। হলুদ শর্ষে ফুলের অবারিত সৌন্দর্য এখন লুটোপুটি খাচ্ছে বিলজুড়ে। মৌমাছির আনাগোনাও ব্যাপক সেখানে। কৃষকেরা বলছেন, শর্ষে চাষে খরচ ও পরিশ্রম দুটোই কম হয়। তেলের দামও তুলনামূলক ভালো। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হচ্ছে।
কাটমারচর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ধসে লবণপানি প্রবেশ করেছিল গ্রামটিতে। এক বছরেরও বেশি সময় লবণপানির নিচে ডুবে ছিল পুরো কাটমারচর গ্রাম। পরে নদের তীরে বাঁধ সংস্কার হলে কিছু মানুষ চেয়েছিলেন বিলের জমিতে লোনাপানি তুলে চিংড়ির ঘের করতে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন ধান চাষের। সেই থেকে বিলে চাষাবাদ শুরু। এরপর গত বছর একজন কৃষক আমন ধান কাটার পর এক বিঘা জমিতে শর্ষের আবাদ করেছিলেন। ফলন ভালো হওয়ায় এবার দেড় শ বিঘা জমিতে শর্ষের চাষ করা হয়েছে।
চলতি মৌসুমে কাটমারচর বিলসহ উপজেলায় ২১০ হেক্টর জমিতে শর্ষে চাষ করা হয়েছে বলে জানালেন কয়রা উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অনুপ সরকার। তিনি বলেন, আমন ধান উঠে যাওয়ার পর বোরো আবাদের আগের যে মাঝের সময়টুকু রয়েছে, এ সময়েই চাষ হয় শর্ষের। মাত্র দুই মাসের মাথায় মেলে শর্ষের ফলন। এবার অনুকূল আবহাওয়া ও ভালো মানের বীজ সরবরাহ থাকায় মাঠে শর্ষের বেশ ফুল ফুটেছে। মাঘ মাসের মধ্যে কৃষকেরা ঘরে শর্ষে তুলতে পারবেন। শর্ষে কেটে ওই জমিতে আবার বোরো ধান আবাদ করবেন তাঁরা। এ বছর শর্ষের ভালো ফলনের হাতছানি দিচ্ছে।
বুধবার সকালে কয়রা উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার পিচঢালা পথ পেরিয়ে কাটমারচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের তীর ঘেঁষে কাটমারচর বিল। শর্ষের ফুলে ফুলে বিস্তীর্ণ বিল হলুদ বরণ ধারণ করেছে। যেদিকে চোখ যায়, মনে হয় কেউ যেন বিলে হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে।
কাটমারচর বিলে নিজের চার বিঘা জমিতে শর্ষে আবাদ করেছেন কৃষক মোশাররফ হোসেন সরদার। তিনি বললেন, বিলটিতে তাঁরা আমন আর বোরো ধানের বাইরে কখনো কোনো ফসলের চাষ হতে দেখেননি। লবণাক্ত ও পানির সমস্যার কারণে তিনি কখনো অন্য ফসলের চাষ করার চেষ্টা করেননি। এবার প্রথমবারের মতো কৃষি গবেষণা বিভাগের পরামর্শে বারি-১৪ জাতের শর্ষে চাষ করেছেন। তারা তাঁকে বিনা মূল্যে বীজ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রথম দিকে অনিশ্চয়তা থাকলেও এখন বেশ ভালো ফুল ধরেছে। আশা করা যাচ্ছে, ফলন ভালো হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কয়রা উপজেলায় দায়িত্বরত বৈজ্ঞানিক সহকারী মো. জাহিদ হাসান বলেন, আগে স্থানীয় জাতের শর্ষে চাষ করায় ফলন কম হতো এবং উৎপাদনে সময় বেশি লাগত। এখন কম সময় ও কম খরচে বারি সরিষা-১৪, ১৭ ও ২০ জাতের চাষ হয়। এতে বপনের মাত্র ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়। গড়ে বিঘাপ্রতি ফলন হয় প্রায় ৬ মণ। শর্ষে কেটে ওই জমিতে আবার বোরো ধান আবাদ হবে। কয়রার দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।