‘বাপ-দাদাগের ১০০ এহরের বেশি জমি ছেলে, হ্যান্নে আমরা নিঃস্ব’
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়নের তেলকাড়া গ্রামের শরিফা বেগম (৫০)। মধুমতী নদীর ভাঙনে বসতবাড়ি ও জমি হারিয়ে এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, তা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়। চোখেমুখে তাঁর আতঙ্কের ছাপ।
মঙ্গলবার তেলকাড়া গ্রামে আলাপকালে শরিফা বেগম বলেন, ‘বাপ–দাদাগের ১০০ এহরের (একর) বেশি জমি ছেলে। বাগবাগিচাআলা বাড়ি ছেলে, তা তিনবার ভাঙ্গিছে। হ্যান্নে আমরা সম্বলনাস্তি, নিঃস্ব। পরের জমি বর্গা করে খাই। হ্যান্নে নদীর কূলই বাড়ি। সামনের বর্ষা–বৃষ্টিতি হয়তো সব শ্যাষ হয়ে যাবেনে।’
শুধু শরিফা বেগম নন, তাঁর মতো অনেকেই মধুমতী নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছেন। কোটাকোল ইউনিয়নের রায়পাশা, করগাতি ও তেলকাড়া—এই তিন গ্রামের প্রবেশপথের একমাত্র রাস্তাটি নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে। তিন দশকে মধুমতীর করাল গ্রাসে তিনটি গ্রামের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ক্লাবঘর, পাকা সড়ক ও বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের খুঁটি নদীর গর্ভে চলে গেছে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা এলাকা ছেড়ে অন্য স্থানে বসতি গড়েছেন। যাঁদের সেই সুযোগ হয়নি, তাঁরা রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন।
২০ বছর কোটাকোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগের চেয়ে বর্তমানে এখানকার জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন ৩টি গ্রামে অন্তত ১০ হাজার মানুষের বসবাস। সর্বশেষ গ্রাম তিনটিতে যাতায়াতের একমাত্র কাঁচা রাস্তাটির চার কিলোমিটার অংশের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে সরু হয়ে গেছে। মোক্তব ঘাট এলাকার প্রায় পুরোটাই নদীতে বিলীন হয়েছে। গ্রামবাসী মোক্তব ঘাট এলাকার কিছু অংশে বালু ফেলে কোনোরকমে চলাচলের রাস্তা করেছেন। তবে এই রাস্তায় এখন ভ্যানও চলতে পারে না। মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু কোনো দপ্তরে ধরনা দিয়ে কাজ হয়নি। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
চলাচলের জন্য নতুন রাস্তা নির্মাণের দাবিতে এবং ভাঙন প্রতিরোধে এর আগে নদীর পাড়ে বিক্ষোভ–সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন স্থানীয় লোকজন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, রায়পাশা থেকে করগাতি হয়ে তেলকাড়া পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা ভাঙনকবলিত। তিনটি গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা মধুমতী নদী। ভাঙনে কিছু গাছপালা নদীতে হেলে পড়েছে। ভাঙনকবলিত বসতবাড়িগুলো একেবারে নদী ঘেঁষে আছে। তিনটি গ্রামে ঢোকার একমাত্র কাঁচা রাস্তাটি নদীর ভাঙনের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে কোনোমতে হেঁটে চলাচল করা যায়।
তেলকাড়া গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা হাসমত শিকদার বলেন, এলাকার মানুষ আগে অনেক অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন। জমিজমা, বাগবাগিচা নিয়ে সুখে–শান্তিতে দিন কাটাতেন। কিন্তু মধুমতী নদী সেই সুখ শেষ করে দিয়েছে।
মধুমতী নদীর বারবার ভাঙনে নিজেদের বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে বলে জানালেন সাবেক ইউপি সদস্য মাহাবুর রহমান। তিনি বলেন, তাঁদের বসতভিটা এখন নদীর পাড়ে। বর্ষায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাবে। এবার বসতবাড়ি ভাঙলে তাঁদের আর মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি নদীর মধ্যে, আবার অন্য পাড় গোপালগঞ্জ জেলার মধ্যে চলে গেছে। এসব জমি জবরদখল করে রেখেছেন এলাকার লোকজন।
নদীভাঙনের শিকার হয়ে অসহায় পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন তেলকাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ফারুক শেখ, গৃহিণী রুব্বান বেগম ও রহিমা বেগম, কষক হেমায়েত মল্লা ও দিদার মিয়া, রায়পাশা গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. মোশাররফ হোসেন, করগাতি গ্রামের নাসির খান ও পাচি বেগম। তাঁরা বলেন, সরকারের কাছে ভাঙনকবলিত এলাকার জনগণের একটাই চাওয়া, সামনে বর্ষার আগে যেন স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গ্রামে চলাচলের রাস্তাটি যেন মেরামত করে দেওয়া হয়।
বুধবার দুপুরে নড়াইলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবদুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। তার মধ্যে ওই এলাকা অন্তর্ভুক্ত। ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষে প্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হবে।