ময়না দ্বীপে পাখিরা স্বাধীন, ওড়ে নির্ভয়ে

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাভূমিতে আসা পরীযায়ী পাখি। গতকাল বিকেলে তোলাপ্রথম আলো

হ্রদের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে শত শত পরিযায়ী পাখি। তাদের কলতানে মুখরিত চারপাশ। তীরের ছোট–বড় গাছের ডালেও পাখিরা এসে বসছে। ভয়ডরহীন পাখিরা চরে বেড়াচ্ছে ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে। পাখি দেখতে আসা মানুষজনের উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা বা শব্দ করা নিষেধ। ঢিল ছুড়ে বা খাবার দিয়ে বিরক্ত করাও বারণ। সর্বত্র তাই অতি সতর্কতা। আর এই কারণেই পাখিরা উড়ছিল নির্ভয়ে।

এমন পাখিবান্ধব পরিবেশ দেখতে হলে যেতে হবে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে। নোবিপ্রবি শীতকালে সাইবেরিয়া, তুন্দ্রা ও হিমালয়সহ বিভিন্ন শীতপ্রধান এলাকার পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ক্যাম্পাসের ছোট–বড় জলাভূমি ঘিরে এসব পাখির বিচরণ সবচেয়ে বেশি। এমনই একটি এলাকার নাম শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন ময়নার দ্বীপ। শান্ত হ্রদ আর গাছগাছালিতে ঘেরা ময়নার দ্বীপ গত কয়েক বছরে পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন প্রয়াস।

শীতপ্রধান এলাকার হরেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে। এদের মধ্যে ধূসর টিটি, জল পিপি, পাতি সরালি, বড় বগা, ছোট পানকৌড়ি, চখাচখি বেশি দেখা যায়।

শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছেই নয়, শহরের বাসিন্দাদের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পাখির রাজ্য। আগে জেলা শহর মাইজদীর কোটের দিঘিতে পাখিদের মিলনমেলা বসত। শহরের কোলাহল ও শব্দ দৌরাত্ম্যের কারণে অতিথি পাখিরা ওই স্থান ত্যাগ করে এখন বেছে নিয়েছে সবুজে ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে।

আমরা পুরো ক্যাম্পাসকে সবুজ ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি জায়গাকে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হলো ময়না দ্বীপ, গেস্টহাউস–সংলগ্ন এলাকা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল–সংলগ্ন জলাভূমি। এসব স্থানে পাখিদের নিরাপদে বিচরণে যাতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন কিংবা কারও কোনো কর্মকাণ্ড পাখিদের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে বিশেষ নজর রাখছি
অধ্যাপক নাহিদ সুলতানা, আহ্বায়ক, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি, নোবিপ্রবি

কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবু রায়হানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি সুযোগ পেলেই পাখি দেখতে ময়না দ্বীপে যান। পাখিদের ওড়াউড়ি, কিচিরমিচির শব্দে মন ভালো হয়ে যায়। হ্রদের কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য পাখি দেখা যায়। সে দৃশ্য অপূর্ব। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।

ক্যাম্পাসে আসা পাখিদের নিরাপদ রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে নোবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি। কমিটির উদ্যোগে ক্যাম্পাসে প্রচারণা ও নজরদারি চালানো হয় নিয়মিত।

ময়না দ্বীপের হ্রদের পাড়ে তারই নমুনা দেখা গেল। এই এলাকার বিভিন্ন স্থানে লাগানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড। যাতে লেখা রয়েছে ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সময়ের দাবি’, ‘ময়না দ্বীপ এলাকায় চাষাবাদ নিষিদ্ধ’, ‘পাখিরা ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব’। এ ছাড়া ময়না দ্বীপ এলাকায় শব্দদূষণ, গানবাজনা, পিকনিক, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, পাখিদের ভয় দেখানো ও ঢিল ছোড়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ময়না দ্বীপ এলাকায় প্লাস্টিক, পলিথিন ও খাবারের প্যাকেট ফেলাও।

পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সাইন বোর্ড
প্রথম আলো

পাখিদের নিরাপদ আবাস গড়তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপকে ইতিবাচক বলছেন শিক্ষার্থীরা। কথা হয় শিক্ষার্থী রিয়াদুল ইসলামের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ময়না দ্বীপসহ ক্যাম্পাসে পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল কিংবা অভয়ারণ্য গড়তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি গঠন করেছে। ফলে এবার দূরদূরান্ত থেকে আসা পাখিরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছে। এ কারণে দিনে দিনে পাখির আনাগোনাও বাড়ছে। এতে আশা করা যায়, আগামী বছরগুলোতে এই ক্যাম্পাসে আরও বেশি বেশি অতিথি পাখির দেখা মিলবে।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাহিদ সুলতানা এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পুরো ক্যাম্পাসকে সবুজ ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি জায়গাকে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হলো ময়না দ্বীপ, গেস্টহাউস–সংলগ্ন এলাকা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল–সংলগ্ন জলাভূমি। এসব স্থানে পাখিদের নিরাপদ বিচরণে যাতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন কিংবা কারও কোনো কর্মকাণ্ড পাখিদের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখছি।’

উপাচার্য মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বিশেষ করে ময়না দ্বীপ পাখিদের জন্য নির্জন ছিল না। ধান চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল। আমরা এ বছর সেই ইজারা বাতিল করেছি। এ কারণে পাখিরা আসছে। এসব পাখি আমাদের অতিথি। আমরা তাদের নিরাপদ রাখব।’