বেধড়ক মারধরে কাতরাচ্ছেন ‘দলপাগলা মিলন’, তাঁর দাবি তিনি ‘চোর’ নন

আহত ইজিবাইকচালক মিলনকে হাসপাতালে দেখতে যান ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির নেতারা। শনিবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

মিলন শেখ (৪৫) পেশায় ইজিবাইকচালক। গ্যারেজমালিকের (মহাজন) কাছ থেকে দৈনিক ভাড়ার চুক্তিতে ইজিবাইক নিয়ে চালিয়ে ঝিনাইদহ শহরে চালাতেন তিনি। এই আয়ে সংসার চালান। এর পাশাপাশি যখনই সময় পান, পছন্দের রাজনৈতিক দল বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে চলে যান। আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকতেন মিলন, তাই সবাই তাঁকে ‘দলপাগলা মিলন’ হিসেবে চেনেন।

গত বৃহস্পতিবার মিলন শেখ শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের বাইরে তাঁর ইজিবাইক রেখে নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষে বাইরে এসে দেখেন, ইজিবাইকটি নেই। সেটি চুরি হয়ে গেছে। এই ঘটনার জেরে গ্যারেজমালিক তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেছেন। তাঁর একটি হাত ভেঙে দিয়েছেন, দুইটি পা পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। এখন হাসপাতালের বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন মিলন।

ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর জোয়ার্দ্দারপাড়ার মৃত ইমান শেখের ছেলে মিলন শেখ। হাসপাতালে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। শয্যাশায়ী মিলন কাতর কণ্ঠে প্রথম আলোকে জানান, দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় ছোটবেলায় পড়ালেখা করতে পারেননি। মাত্র দুই শতক জমির ওপর দুই কক্ষের টিনের চালাঘরে বসবাস করেন। তাঁর তিন সন্তান; বড় ছেলে মিটন শেখ (২৫) ঢাকায় একটি কাঠের আড়তে কাজ করেন। মিটন বিয়ে করে পৃথক সংসার করছেন। বড় মেয়ে মিলির (১৯) বিয়ে দিয়েছেন, আর ছোট মেয়ে মুনিয়া (১০) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে।

মিলন শেখ জানান, ১৫-১৬ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন সবজি বিক্রির কাজ। এরপর বাজারে ইজিবাইক এলে চালানো শুরু করেন। বর্তমান মহাজন ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর এলাকার ওবাইদুল ইসলামের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫১০ টাকা ভাড়ার চুক্তিতে ৯ বছর ধরে ইজিবাইক চালাতেন। এই গাড়ি চালিয়ে তাঁর দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হতো। এই আয় দিয়ে তিনজনের সংসার কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল।

মিলন বলেন, তিনি বিএনপির রাজনীতি ভালোবাসেন। শহরে সব কটি মিছিলে তাঁর থাকা চাই। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভোরে মিছিল হতো, সেখানেও তিনি সামনে থাকতেন। এর বাইরে তিনি আর কিছুর সঙ্গে মেশেন না। বৃহস্পতিবার সকালে ওবাইদুল ইসলামের গ্যারেজ থেকে একটি ইজিবাইক নিয়ে বের হন। রোজা থাকায় দুপুরে বাড়ি ফিরতে হয়নি। সারা দিন ভাড়া খেটে সন্ধ্যায় ইফতারি শেষে চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে পুকুর পাড় মসজিদের সামনে গাড়ি রেখে নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষে বের হয়ে দেখেন, তাঁর গাড়িটি নেই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আশপাশে খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। মসজিদের সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখার জন্য মালিককে ফোন দিয়ে ডেকেছেন, কিন্তু তিনি আসেননি। শুধু বলেছেন, ইজিবাইক ছাড়া গ্যারেজে এলে তাঁর অবস্থা খারাপ হবে।

মিলন জানান, তারপর গ্যারেজে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাজন প্রশ্ন করেন, ‘কোথায় বিক্রি করেছিস বল।’ তিনি অনেক অনুনয় করলেও লাভ হয়নি। গ্যারেজের মধ্যে ফেলে বাঁশ আর লোহার রড দিয়ে বেদম মারপিট করেন। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ সময় গ্যারেজমালিক ওবাইদুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে জানিয়ে দেন, ইজিবাইকের মূল্য দেড় লাখ টাকা না দিলে তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হবে।

মিলন জানান, তাঁর দুই পা আর দুই হাতে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। এতে বা হাতটি কনুইয়ের নিচ থেকে ভেঙে গেছে। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। এই অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন একই মহাজনের গাড়ি চালাচ্ছেন, তারপরও চোর অপবাদ দেওয়া হলো। আর চোর সাজিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে দিল। তিনি এর বিচার দাবি করেন।

মিলন শেখের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালর কর্তব্যরত চিকিৎসক মেফতাহুল জান্নাত জানান, তাঁর বাম হাত ভেঙে গেছে। ইতিমধ্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে ভর্তি রয়েছেন।

মিলন শেখের স্ত্রী রাহেলা শেখ বলেন, স্বামী হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। সংসারে স্বামীই আয়ের একমাত্র অবলম্বন। এখন তাঁদের সংসার চলছে খুবই কষ্টে। ইতিমধ্যে স্বামীর চিকিৎসায় প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। হাত ভালো না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজেও যেতে পারবেন না, চিকিৎসায় আরও খরচ হবে। এখন ভেবে পাচ্ছেন না, তাঁর ও শিশুসন্তানের কী হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পৌর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘মিলন শেখ দলের একজন পরীক্ষিত সৈনিক। যখন ১০ জন মিছিল করত, তার মধ্যে মিলন একজন। তার জন্য দলের পক্ষ থেকে আমরা সব আইনগত ব্যবস্থা নেব। ইতিমধ্যে জেলা বিএনপির নেতারা তাকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন।’ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মজিদ বিশ্বাস জানান, তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন মিলনকে দেখতে। তাঁর জন্য দলীয়ভাবে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান।

বিষয়টি নিয়ে গ্যারেজ মালিক ওবাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ইজিবাইকটি সে চোরচক্রের মাধ্যমে বিক্রি করেছে এই সন্দেহে তাকে স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হয়। এ সময় একটু মারধর হয়েছে, কিন্তু যতটা বলা হচ্ছে, ততটা নয়।’ তবে তিনি হাসপাতালে খোঁজখবর রাখছেন, ছেলের মাধ্যমে ২ হাজার টাকাও পাঠিয়েছেন। প্রয়োজনে চিকিৎসার আরও খরচ দেবেন বলে জানান।